0

ব্যস্ততার টোপর

Share

ঊর্মি চৌধুরী

ভোরের আলো চোখের পাতায় ছুঁয়ে গেলে,পাশের এক টুকরো খালি প্লটটাতে পাইলিংয়ের শব্দে কেঁপে উঠছে যখন, ডেকে বলছে কেউ ‘ও মানুষ ওঠো এবার, তোমার ছুটবার সময় হলো বলে।’ রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলোয় চুম্বন কাটে, সন্ধ্যেনামা বিকেলটা অস্তগামী সূর্যের লালিমায় নিজেকে সঁপে দেয় আরেকবার আলোকিত ভোরে দেখা হবে বলে, আর মানুষ সে দুর্নিবার।

রাতে দেখা স্বপ্ন ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায়, মানুষ ভুলেও যায় স্বপ্নটা কী ছিলো! বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগই বা কতটুকু! মিছে এ নিয়ে চিন্তা করার কোনো অবকাশই নেই। কিন্তু একটা সুখপাখিকে খাঁচায় বন্দী করার নেশায় মানুষ আদিকাল থেকে যে স্বপ্ন লালন করে বুকে তার সমাপ্তি কোথায়? সুখপাখিটা ডানা মেলে উড়তে থাকে আপন আকাশে আর মানুষ ফাঁদ পাতে ভিন্ন ভিন্ন খাঁচায়।

আমি, আমরা, তুমি ছুটছি সারাবেলা। কভু জীবনের তাগিদে, কভু মোহ মরীচিকায়। প্রয়োজন মানুষকে চড়কিতে ঘোরাচ্ছে। মানুষ ছুটছে, প্রতিনিয়ত ছুটছে, একটা অস্পষ্ট অধরাকে সামনে রেখে নিরন্তর পথচলা মানুষের। তাকে স্পর্শের অনুভূতিতে আনার জন্যে ব্যয় করছে সেকেন্ড, মিনিটের হিসেবে কত শত মুহূর্ত। শরীর আর মনের ডাকে সাড়া দিয়ে শিরা ধমনী হৃৎপিন্ডটা ব্যস্ত সময় পার করছে, মস্তিষ্কের নিউরণে জমা হচ্ছে কত কত স্মৃতি, মেধার বিকাশে ক্ষরিত হচ্ছে জ্ঞানরস, জানার পরিধি বাড়ছে নিরন্তর, শরীরের ছোটো বড় কলকব্জাগুলোও দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে কখনও ক্লান্তির কোলে মাথা নোয়ায়, কিন্তু দমে যাওয়ার অবকাশ কোথায়! তাকে যে আবারও রেসের ঘোড়ার সওয়ারী হতে হবে।

কেউ হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছে, তাকে প্রণাম করতে গিয়েই আরও একটা ইশারায় ডুবছে, আরও একধাপ  ওপরে উঠার লড়াই তাকে ময়দান ছাড়তে দেয় না। সে এগোয় আর এগোয় ধাপটাও নির্দিষ্ট সীমারেখায় থাকে না বলে নিচে নেমে আসে না, সুতরাং লড়াইটা থামে না আর। কেউ কেউ বেমালুম ভুলে যায়, জানে না কোথায় গিয়ে থামতে হবে তাকে।

এই যে সম্মুখের পথ ধরে এগোচ্ছে মানুষ কখনও মসৃণ, কখনও বন্ধুর পথের দুপাশে তাকানোর সময় কই! রেলগাড়ী ছুটার সময় যেমন দুপাশটা অভিমানে পেছনে দৌড়াতে থাকে, তেমনি জীবনের গতিপথে আশপাশে হয়তো ক’টা করুণ চোখ তাকিয়ে থাকে একটিবার সময় হলো না তোমার! একটা ইশারা একটা হাতছানি তাকে চোখের পলক ফেলতে দেয় না। চলাটা নিখুঁত হয় না হয়তো, হোঁচট লাগে আবারও উঠে দাঁড়ায়, ছায়াটা জিজ্ঞেস করে ব্যথা পেয়েছিস? উত্তর দেওয়ার সময় থাকে না, বা প্রশ্নটা শুনতেও পায় না। রেলগাড়ী নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছালেও মানুষ জানে না গন্তব্য কত দূরে!

ক্লান্ত সময় বেঁকে বসে যখন, নিঃশ্বাসটা গরম বাতাসে হাঁসফাঁস করে, তখন মানুষ বুঝি বড্ড একা! ফাঁকা চারপাশ। বিনোদন খোঁজে প্রকৃতির কাছে। ভেতরটা মনে হয় খইয়ের মতো ফুটছে, আর বলছে -হে সমুদ্র তুমি লোনাজলে ক্লান্তি ধুয়ে দাও আমার। ঐ যে দূরের নীল পাহাড়টা! তোমার মতো মাথা উঁচু করে স্থির হবো কবে! না স্থির হয় না, অনাহূত পথিক হয়ে পাহাড়ের কোলে চড়ে মেঘ ছুঁতে চায় সে, বৃষ্টি ঝরুক ভিজে শ্রান্ত হবে বলে।

ছুটে চলার নামই জীবন, থেমে যেতে চায় না বলেই পথের বাঁকে পথ খুঁজে মানুষ। নিত্য নতুন পথে পা ফেলে পুনরায় শুরু করে, কেউ কেউ আবার শূন্য থেকে শুরু করে। হয়তো  “থেমে গেলে তো হেরে গেলে” রোগে আক্রান্ত আমরা সবাই। দলবল নিয়ে ছুটে চলার সময় কই!!

সমুদ্র সেঁচে মুক্তো আনতে, এভারেস্টের চূড়া ছুঁতে, চাঁদের মাটিতে পা রাখতে, পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পুরে মঙ্গলে বসতি গড়ার চেষ্টাতে মানুষের আজন্ম পিপাসা, এটা থাকবেই। এতে ব্যতিক্রম নেই, ভ্রম নেই। তবু ভুল হয়ে যায় অন্য কোথাও। ভুল হয় আমাদের ভোগে, লালসায়, আত্মকেন্দ্রিকতায়। ভুল হয় অতৃপ্ততায়।

বিলাসিতার জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, দৈনন্দিন জীবনটা যাপনের জন্যে ততটুকু নয় কিন্তু। এই সত্যটা প্রকৃতি বুঝিয়েছে বারবার, বহুবার। মানুষ তাকে অগ্রাহ্যও করেছে, ছুটেছে মোহের পেছনে। সবুজ, নরম আবেগটাকে ঘুম পাড়িয়ে মনের ভেতর জেগে ওঠে মরীচিকার পাহাড়। তাকে ছোঁয়ার তীব্র ইচ্ছেটা চুম্বকীয় আকর্ষণে টানছে। দিনশেষে মানুষ প্রাপ্তির আনন্দে জয়োল্লাস করে, অপ্রাপ্তিতে হতাশ হয়। শুধু ডানে বামে পশ্চাতে পড়ে থাকে আমাদের উপেক্ষিত ভালোবাসা, আত্মীয়তা, আতিথিয়েতা, শেকড়ের টান।

এই যে বেঁধে দেওয়া আয়ু থেকে ঝরেছে সময়, কৃষ্ণ চুলে সফেদ রূপোলি রঙের আগমন কভু হয়তো রঙিন প্রলেপে ঢাকছে, চোখের দৃষ্টি সীমানা উঠছে আর নামছে চৌকোনা ফ্রেমের মাঝে নয়তো লেন্সের সংযোজনে। বুক পাঁজরের খাতায় এলোমেলো আঁচড়ে তৈরি হয়েছে অগণিত স্মৃতিফলক, উদাস মনটাকে ধোয়ারও দুদণ্ড অবসর হয়নি কভু, ঠোঁটকাটা বার্ধক্য তখন ডেকে বলে এবার থামো। আর নয়…!

স্মৃতিরা ডাকছে শৈশব কৈশোরের কোলাহলে এক্কাদোক্কা খেলায়,পুরোনো দিনের গানের লিরিক্স কর্ণকুহরে ফিসফিসিয়ে যায়, হয়তো তারুণ্যের বাহুডোরে বাঁধতে চায় আরেকটিবার, বোকা মন অবুঝ প্রশ্ন করে বসে আমাকে, ফিরতি ট্রেনের টিকেট পাবো কোথা থেকে?

জীবনের গল্পটাকে কবিতায় সাজালে হয়তো এমনই আসে লাইনগুলো….

বেলাশেষে আমাদের ভুলগুলো ফুল হয়ে ঝরছে

নিস্তব্ধতার আঙিনায়

আমরা ব্যস্ত হই ঝরাফুল কুড়োতে,

নিঃশ্বাসে শেষ ঘ্রাণটুকু টেনে নিতে,

রঙ ছুঁয়ে ফিরে যেতে চায় মন

অনাদিকালের শ্রেষ্ঠ ব্যস্ত দিনগুলিতে।

সূর্য তখন শেষ রঙটুকু বিলিয়ে অস্তাচলে, ডুবে যেতে চায় তার আপন গুহায়।

আমরা পারি না তার যাত্রা রুখে দিতে,

দীর্ঘায়িত করতে কিংবা 

এতটুকু বিলম্বিত করতে।

নিষ্ঠুর তার সময়যন্ত্র, নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়া, পথচলা

আমার অপেক্ষায় নষ্ট করার সময় তার হাতে নাই।

যদি ফেরারী পাখি হয়ে ফিরে যাওয়া যেতো,

ঐ আঁতুরঘরের উষ্ণতায়,

পেছনে মাড়িয়ে আসা আলপথটা ধরে যদি 

পুনঃ পুনঃ হেঁটে আসা যেতো 

পায়ের ছাপে হলদে হওয়া ঘাসগুলো আবারও

সবুজ হতো যদি,

পথের বাঁকে মনভুলে ফেলে আসা 

রত্নগুলি খুঁজে নিতাম,

যত্ন করে তুলে নিতাম হীরে, পান্না, চুনিগুলো। 

আঁধারের আলিঙ্গনে, এই নিরিবিলি স্টেশনে কত ভয়,

দুরু দুরু কাঁপুনিতে দুলছে হৃদয়

আমি তো একা থাকিনি কভু,

পদে পদে খু্ঁজে নিয়েছি তোমাদের, তোমায়

আশপাশে কেন কেউ নেই তবে, আমার আপনেরা কই?

আমায় একা রেখে কোথায় যাও সবাই?

বলে তো যাও কেউ,

ফিরতি ট্রেনের টিকেট কাটা হয় কোন কামরায়?