জেসমীন আক্তার
শারীরিক অসুস্থতার জন্য গতকাল স্কুল ছুটি নিয়েছিলাম। কিন্তু সকাল ছয়টা থেকেই চলমান জীবনের পায়তারা শুরু। ছেলের আটটার মধ্যে কোচিং,মেয়ের নয়টার মধ্যে স্কুল যাওয়া, নিজে বিছানায় একটু গা এলানোর সময় কই? উঠলাম, নাশতা রেডি করলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, বের হলাম মেয়েকে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে। অঝোরে ঝরছে আকাশের কান্না, ছাতা হাতে আমি মেয়েকে একটু গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেই রিকশার খোঁজে এগুচ্ছি।
কেউ পলিথিন মাথায়, কেউ খালি মাথায় ভিজে চুপসে রিকশাগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কারোরটাতে প্যাসেঞ্জার আছে, কারোরটা খালি। কেউ থামছে না,উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে…
অগত্যা রিকশা না পেয়েই হাঁটা শুরু করলাম। এক হাতে ধরে রাখা ছাতা মেয়ের মাথায় ,চোখের দৃষ্টি পুরোই মেয়ের পায়ের দিকে, জায়গায় জায়গায় জমে থাকা পানিতে মেয়ের পা যেন না পরে সেই চেষ্টায়। দিন দিন কতো ভাবেই না মা হওয়াকে উপলব্ধি করছি।
অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়ার পরও যখন কোনো বাহন পেলাম না, সামনে জমে থাকা হাঁটু পর্যন্ত পানি দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সময় পেরুচ্ছে, মেয়ের পরীক্ষা,যেভাবে হোক স্কুলে পৌঁছাতে হবে। আমিও শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম, সামনে যে বাহনই আসুক প্রাইভেট কিংবা পাবলিক, প্যাসেঞ্জার থাকলেও থামাবোই।
যেই ভাবা সেই কাজ,দুই মিনিটের মধ্যে সেখানে এক সিএনজি এলো, ভেতরে দুই জন বসা। কি ছিল আমার কথায় জানিনা, প্রথমে হাত দিয়ে ইশারা করে, তারপর জোরালো ভাবেই বললাম একটু থামান,আমার মেয়ের পরীক্ষা, রাস্তাটুকু পার করে দিন প্লিজ।
বাহনটি একটু দূরে গিয়ে থেমে গেল। ভেতর থেকে ভদ্রলোক মাথা বের করে জানতে চাইলেন কোথায় যাবো এবং এও বললেন তার মেয়েও এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ভদ্রলোক নিজে বের হয়ে তার মেয়ের সাথে আমাকে এবং আমার মেয়েকে বসতে দিয়ে তিনি বসলেন ড্রাইভারের পাশে।
উপকারিতা কিংবা বিনয় মানুষকে যে কত বড় করে তার উদাহরণ আরেকবার পেলাম। নিরাপদ স্থানে আমাদের নামিয়ে দেওয়ার পর সৌজন্যমূলক বাক্য ব্যয় করতে কার্পণ্য করিনি। পরীক্ষার্থী মেয়েটির প্রতি শুভকামনাও রেখে দিলাম।
মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে, ফিরতি রিকশায় বাড়ি পৌছলাম অনেকটা মন খারাপ নিয়েই। বৃষ্টি বিলাসী মন কত গান, কবিতাই না লিখে যাই মনের আনন্দে…।
কি দেখলাম…. খেটে মানুষের কর্ম বন্ধ, কিংবা গন্তব্যে পৌছানোর দূর্ভোগ, কত আশ্রয়হীন মানুষের আশ্রয়ই যদি হয় কোনো ছাউনি যুক্ত স্থান, তারা কেমন থাকে সেসময় জানিনা।
ফিনফিনে ভেজা শার্টের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়, রিকশাচালক চাচার গায়ের হাড়গুলো যখন গুনে নিতে পারছিলাম, তখন আমার কেমন লেগেছিল, সে অনুভূতির ভাষা আমার কলমে আসছে না, ভাড়া বাবদ দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়ে কি মূল্যায়ন করতে পারবো?
রাস্তার কুকুর বিড়ালগুলো জায়গায় জায়গায় কোণঠাসা হয়ে দাঁড়ানো, যেখানে ওরা সকাল হলেই আস্তাকুঁড়ে, নির্দিষ্ট কোনো বাড়ির গেটে কিংবা বিভিন্ন হোটেলের পরিত্যক্ত খাবারের আশায় ঘোরাঘুরি করে। সবই প্রায় বন্ধ, নির্বোধগুলো কতটা শান্ত হয়ে থাকে, একটু চিৎকারও করে না। ওরাও তো জীব! ক্ষুধা বোধ, শীত বোধ ওদের কেমন হয়, চিৎকার করে বলতে পারলে কেমন হতো পরিবেশ, সেই ভাবনাও রয়ে গেল মনের কোণে।
বারান্দায় বসে কত-শত সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখলাম গাছের ভেজা পাতার ফাঁক থেকেই দুই একটা পাখি উঁকি মারছে, দুই একটা আবার কারো বারান্দার গ্রিলে। বারান্দা লাগোয়া কার্নিশে ভেজা কাকটি সমানে কা কা করছে একটু খাবারের জন্য নাকি ভেজা পাখাগুলোকে একটু রোদে শুকানোর জন্য,তা আর জানা হলো না।
স্মৃতির মেঠো পথ ধরে বহু দূর চলে গিয়েছিলাম ততক্ষণে…রিকশার হুড ফেলে ভিজতে ভিজতে কলেজ থেকে ফেরা দুই বন্ধু তুমুল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে নৌকা পাড় হওয়া,আরও অনেক কিছু…ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মায়ের বকুনিও উজ্জ্বল তারার মতোই জ্বলে উঠলো।
মায়ের কথা মনে হতেই নিজের মাতৃত্বের কথাও মনে হলো…বাচ্চারা এই বৃষ্টির মধ্যে খিচুড়ি পেলে খুব খুশি হবে, তাই আর দেরি না করেই রান্নার কাজে সমর্পিত হয়ে নিজের শারীরিক অসুস্থতাকে শিকেয় তুললাম।