শায়লা শবনম
আংরাভাসা নদীর তীরে চা বাগানের কোয়ার্টারের সীমানায় সন্ধ্যাবেলায় গাছের উঁচু ডাল থেকে চাঁপা ফুল তুলে আর ভোরের আবছা অন্ধকারে আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল কুড়িয়ে বালিকাটির গল্প শুরু হয়েছিল। ফুল কুড়ানোর সময় তাকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাতে দেখে চা বাগানে বেড়াতে আসা এক সদ্য তরুণ মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিল, ‘সুচিত্রা সেন!’ মা-ঠাকুমার চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে বারবার খোলা মাঠে ছুটে বেড়ানো, মেঠোপথ ধরে নিজের খেয়ালে ঘুরে বেড়ানো অদ্ভুত প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর এক বালিকা। দুই ছেলে বন্ধুর সাথেই তার যতো সখ্যতা, কোন মেয়ের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল না। মা ঠাকুমা ছেলে বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করতে দেখলে রাগ করতেন। যদিও মা-ঠাকুমার এমন রাগের কোন কারণ খুঁজে পায়নি মেয়েটি।
একদিন সমবয়সী বালক বন্ধুদের সাথে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে হাতির তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে পারলেও জীবনের চরম নিষ্ঠুরতা থেকে পালাতে পারেনি বালিকাটি। মাত্র এগারো বছর বয়সে বিকৃত মানসিকতার দুশ্চরিত্র, লম্পট এক প্রভাবশালীর প্রতাপের বলী হয়ে তার অসুস্থ পুত্রের বধু হয়ে তাকে ছাড়তে হয় চা বাগান। অথচ একদিন পরেই আবার সেখানে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় সে। পরের দিন সংবাদ আসে তথাকথিত স্বামীটি না ফেরার দেশে চলে গেছে মেয়েটিকে একরাশ স্বস্তি দিয়ে। কিন্তু শুধুমাত্র বিয়ে নামের একদিনের পুতুল খেলায় অকাল বৈধব্য লেখা হয়ে যায় তার ললাটে। ততক্ষণে সে জেনে গেছে আরও একটি নির্মম সত্য, যাদেরকে বাবা মা বলে জানতো এতকাল, তারা তার জন্মদাতা জন্মদাত্রী নয়।
এতটুকু যারা পড়ে এসেছেন, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলা হচ্ছে? হ্যা, বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী চরিত্র, দীপাবলি। সমরেশ মজুমদার রচিত দীর্ঘ উপন্যাস ‘সাতকাহন’ এর মূল চরিত্র দীপাবলি। শুধুমাত্র নারী চরিত্র হিসেবেই নয়, উপন্যাসের এক শক্তিশালী আপোষহীন চরিত্র হিসেবে দীপাবলি বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ পাঠকের কাছে ভীষণ প্রিয়।
জীবনের নিষ্ঠুর সত্য আর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতেই অন্ধকার আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন চা বাগান থেকে স্বাধীনচেতা দীপাবলি একসময় পৌঁছে যায় ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ সরকারি চাকরি আই আর এস পদে। কিন্তু এই উত্তরণের পথটা মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য। স্বপ্ন পূরণের জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল পথ। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে শৈশবের প্রিয়জনেরা। একা, একদম একা শুধুমাত্র প্রবল জেদ আর সুদৃঢ় মনোবল দীপাবলীকে সমাজের সম্মানজনক উচ্চতর অবস্থানে পৌঁছে দিলেও স্বাভাবিক জীবন সে পায়নি কখনোই।
চাকরি জীবনের পদে পদে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনৈতিকতা আর চারিত্রিক স্খলনের দৌরাত্ম্য সংগ্রামী নীতিবোধসম্পন্ন দীপাবলীকে আরও বিপর্যস্ত, আরও একা করে দেয়। একসময় সমাজের উঁচু স্তর থেকে জীবনসঙ্গী বেছে নিয়ে ব্যক্তি জীবনের একাকীত্ব দূর করতে চাইলেও সেখানেও মানিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না আপোষহীন দীপাবলির। জীবনে আবার নেমে আসে সেই একাকীত্ব, সেই নিঃসঙ্গতা। অতঃপর তার সঙ্গী হয় আরেকজন পোড় খাওয়া নিঃসঙ্গ নারী, ঠাকুমা বলে যাকে জেনেছিল আশৈশব থেকে। একসময় নিজের কাছেই তার জিজ্ঞাসা, সে কি অসামাজিক? সে কি অস্বাভাবিক? সে কি বিধাতার এক ছন্নছাড়া সৃষ্টি?
‘দীপাবলী’ চরিত্রের প্রভাব শুধু গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দীপাবলী একটা প্রতিবাদের নাম, একটা সংগ্রামের নাম, আদর্শের নাম, একটা প্রেরণার নাম। এ যেন এক হার না মানা নারী। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নানা প্রশ্ন তার মনে জমা হতো। নানা সংস্কারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী রূপ তার মধ্যে দেখতে পাই আমরা। কেন বিধবার মাছ, মাংস খাওয়া হারাম এমন প্রশ্ন সেই বালিকা বয়স থেকেই মনে জমা হতো তার। যদিও এর কোন সদুত্তর কখনো কারো কাছে পায়নি সে। দীপাবলির নামের মধ্যেই যেন নিহিত আছে অন্ধকারের বিরুদ্ধে, প্রথার বিরদ্ধে এক শক্তিশালী বিদ্রোহের আভাস। দীপাবলী আমাকে বার বার ভাবায়, হৃদয়ের কোথায় যেন ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। নিজের সাথে কোথাও যেন সাদৃশ্য খুঁজে পাই দীপাবলি চরিত্রের। তাইতো তাকে গল্পের নায়িকা নয়, রক্তমাংসের মানুষ বলে ভ্রম হয়। খুব, খুব আপন মনে হয় দীপাবলীকে।
সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ পড়ে আমার দুঃখবোধ আসে, কলকাতার বা ভারতের লেখকেরা যে সত্য, সমাজের দুর্নীতি আর কূপমণ্ডূকতার যে চিত্র নিঃসংকোচে তুলে ধরতে পারেন আমরা সেটা পারি না একেবারেই। আমাদের ‘হারাই হারাই, সদা হয় ভয়’। সর্বত্র নিষেধাজ্ঞা আর কঠোর আইন কানুনের শৃঙ্খল আমাদের চারপাশে বেড়ি হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়া। এ কারণেই দীপাবলীর মতো চরিত্র আমাদের সাহিত্যে তৈরি হয় না। এমনকি কোন দৃঢ়চেতা নায়ক চরিত্রও নয়। নমনীয়, কমনীয়, রমণীয় নারী চরিত্র আর বাউণ্ডুলে, খামখেয়ালি, উদ্ভট পুরুষ চরিত্রগুলোই আমাদের লেখকেরা সৃষ্টি করেন তাদের লেখায়। এমন নির্দোষ চরিত্রের আড়ালে নিজেরা নিরাপদ বলয়ে অবস্থান গড়ে নেন। আমাদের দেশে এরাই জনপ্রিয়তা পায়।
‘সাতকাহন’ বারবার পড়েও আবার পড়ি। প্রতিবার নতুন করে আবিষ্কার করি বইটিকে। নতুন ভাবনায় ঋদ্ধ হই আবার। দীপাবলি হয়ে ওঠে এক প্রতিবাদী, আদর্শের সমার্থক নাম।