0

নীলখামের চিঠি

Share

ঊর্মি চৌধুরী 

চায়ের মগ হাতে সেঁজুতি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। একমনে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরে,দৃষ্টি যতটা যায়। পাশেই লিভিং রুম থেকে গুনগুনিয়ে ভেসে আসছে ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ….শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।’ এমনটা নয় যে আজ বৃষ্টি দেখেই সে এখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে, রোজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা এমনকি কোনও কোনও রাতেও বারান্দায় আবছা আলো আঁধারে রকিং চেয়ারে কেটে যায় সময়। এই চওড়া বারান্দাটা যে তার খুব প্রিয়। কত কথা! কত ভালোলাগার সাক্ষী এই বারান্দা তা শুধু সেঁজুতিই জানে। এখন অবশ্য মন খারাপের বিকেলটা একাকী কাটে আনমনে।

আজও গাঢ় লিকারের এক মগ চা নিয়েই বৃষ্টির কান্না দেখছিলো। কেন যেন মনে হয় তার গুমোট ব্যথাগুলোই বৃষ্টির কান্না হয়ে ঝরছে। অথচ শ্রাবণের এমন বারিধারা তার কাছে মন ঘুঙুরের বার্তা নিয়েই আসতো, একদম উড়নচণ্ডীর মতো নেচে উঠতো মন। নীল এর সাথে সে কী খুনসুটি তার! বিয়ের পরপর ছুটির দিনে এমন বৃষ্টির দুপুর বেডরুমে হেমন্তের গানে শুয়ে বসেই কাটাতে চাইতো নীল, কিন্তু সেঁজুতির যেন ময়ূরের মতো পাখা মেলে নাচতে ইচ্ছে করতো। নীলকে একরকম জোর করেই টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যেত ও। কখনও হুড খোলা রিক্সায়, কখনও রাস্তায় ভিজে একাকার হতো দুজনে। নীল প্রথমে না করলেও বাইরে বের হলেই পুরোপুরি ফিট,তখন সে পুরোদস্তুর প্রেমিক। খুব ভালো আবৃত্তি করতো,রবি ঠাকুরের কবিতা তার ঠোঁটে ভালোবাসার ফল্গুধারার মতো ঝরতো। সেঁজুতি ভেজা চোখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতো নীলের দিকে। নিজেকে তখন উপন্যাসের নায়িকা মনে হতো। হবে নাইবা কেন এমন প্রেমিক ক’জনার ভাগ্যে জোটে!!

হঠাৎ মনে পড়লো কাল বিকেলে চিঠিবক্সটা হাতড়ে একটা নীলখাম বের করেছিলো সে,প্রেরকের নাম ঠিকানা কিছুই লেখা নাই তাই খুলে দেখা হয়নি। ইচ্ছেও করলো না। এই ক্ষুদেবার্তার যুগে কে তারে চিঠি পাঠাবে! ডাকপিয়নই বা কোথায় চিঠি পৌঁছানোর! নিছক কারও মনগড়া দুষ্টুমি। তাই আবারও বক্সেই রেখে দিয়েছিলো। এই চিঠিবক্সটা তো এখন একটা শো-পিসই বটে। এখানে ভুল করেও কেউ চিঠি রেখে যায় না,কোনো প্রেমিক কলমের কালিতে গহীনের আবেগও ঝরায় না। তবে এই চিঠিবক্সের ইতিহাসও খুব রোমাঞ্চকর।সেঁজুতি স্মৃতির পাহাড়কে যতই পাশ কাটিয়ে চলে দূরের নীল পাহাড় ততই ইশারাতে ডাক দেয় তাকে। এটাকেই বুঝি একাকিত্বের দোলাচল বলে! 

একদিন মধ্য দুপুরবেলা নীল এই কালো রঙের চিঠিবক্সটা নিয়ে হাজির ক্যাম্পাসে। তারা দুজনই তখন ঢাকা ভার্সিটির ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। নীল মফস্বলের ছেলে মেসে থেকেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলো, আর সেঁজুতি নিজের বাসা থেকেই ক্লাসে যেতো। মা বাবার একমাত্র কন্যা যেমনটি আদুরে তেমনই আহ্লাদী। আদিখ্যেতার শেষ নাই। ওদের দুজনের চোখে আগুনের ফুলকি, মনে কৃষ্ণচূড়ার রঙ। প্রেমের তরী ভাসিয়ে দিব্যি পাড়ি দিয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী,সামনে যা পায় সবই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে প্রেমের স্রোতে,তাই কোনো বাধাই যেন বাঁধা হয়ে আসেনি। কিন্তু সেবার কী হয়েছিলো নীল মেস থেকে হঠাৎ উধাও,বলা নাই কওয়া নাই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। বাড়িতে গেলে সেঁজুতিকে  জানিয়েই যায়,কিন্তু কী বিপদ ঘটলো কোথায় গেলো কিছুই বলে যায়নি নীল। দুই/তিনদিন পর সেঁজুতি অস্থির হয়ে উঠলো। ক্লাসের কেউই জানে না নীল কোথায় গেছে। তিনদিনের মাথায় এক বান্ধবীকে নিয়ে নীলের মেসে গিয়ে দেখলো তার রুমমেট কেউ জানে না নীল কোথায় কেন গেছে। কাপড় চোপড় সব সেভাবেই গুছানো আছে,শুধু নীল নেই। পাশের রুমের একজন বললো,তিনদিন আগে নীলকে খুব তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যেতে দেখেছে,কিন্তু কোনো কথা হয়নি। এবার সেঁজুতির কান্না পাচ্ছে খুব। তাকে তো কিছু একটা বলে যেতে পারতো,নয়তো কারো দিয়ে খবর পাঠাতো। তাছাড়া নীলের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা সে জানে না,শুধু জানে উত্তরের জনপদ রাজশাহীর কোনো এক উপজেলার মফস্বলে থাকতো সে। প্রতিদিন মেসে গিয়ে এক একটা চিঠি লিখে খামে পুরে রেখে আসতো সে। বলে আসতো নীল এলেই যেন চিঠিটা পৌঁছে দেয়। এভাবে প্রায় ডজন খানেক চিঠি জমা হয়ে গেলো কিন্তু ফিরতি খামে চিঠিও আসে না,নীলও আসলো না।

দিন পনেরো পর সেই মধ্যদুপুরেই চিঠিবক্স হাতে নীল সেঁজুতির সামনে এসে দাঁড়ায়।ফেরত খামে এক ডজন চিঠির উত্তর লিখে চিঠিবক্সটা নিয়ে এসেছিলো। বলেছিলো সদর দরজাতে ঢুকতেই বক্সটা ঝুলিয়ে রাখতে,সময়ে অসময়ে চিঠি আসবে ওটাতে।

সেবার এক পক্ষকালের অভিমান ভেঙেছিলো নীল এর নানা ঢঙে রোমাঞ্চকর চিঠির উত্তরে। নীল কেন কিছুই না জানিয়ে উধাও হয়েছিলো তার ব্যাখ্যাও আছে তাতে। নীলের মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটেছিলো সে,আর প্রাণের চেয়েও প্রিয় মায়ের অসুখ না সারা পর্যন্ত তার হুঁশজ্ঞান  ছিলো না,তাই ফেরা হয়নি বেশ কদিন।সেই থেকে চিঠিবক্সটা সেঁজুতি আগলে রেখেছিলো দেয়ালে ঝুলিয়ে। মাঝেমধ্যেই নীল প্রেমের চিঠি পুরে দিত। এমনকি তাদের বিয়ের পরও মান অভিমান চলাকালে নীল অফিসে যাওয়ার সময় চিঠি রেখে যেতো বক্সে,আর নীল চলে গেলে সেঁজুতি তা পড়ে হেসে কুটিকুটি হতো। অভিমান জমে অভিযোগ হওয়ার আগেই নিমিষেই ফুড়ুৎ হয়ে যেতো। 

পড়ার পাট চুকিয়ে তাদের প্রেমের পরিণতিতে খুব একটা বাধা আসেনি। যদিও নীল মফস্বলের ছেলে তার ভালো ফলাফল,স্মার্টনেস তাকে খুব সহজেই একটা মাল্টিনেশনাল কোম্পানিতে চাকুরী পেতে সাহায্য করে,দারুণ বাকপটু ছিলো সে। তাই সেঁজুতির মা-বাবা একমাত্র মেয়েকে তার প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দিয়ে শান্তি খুঁজে নিয়েছিলো।

বিয়ের পর ছুটিতে সেঁজুতি নীলের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতো সবসময়। গ্রামের খোলা হাওয়ায় নীলের পরিবারের আন্তরিকতা তাকে যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিয়েছিলো। ঢাকা,রাজশাহীতে আসা যাওয়া,উড়োচিঠি, মন ঘুঙুরের তালে প্রেমের নৃত্যে গড়িয়ে যাচ্ছিলো সময়। একদিন নীলের অফিস থেকে দেশের বাইরে ট্যুরে যাওয়ার আয়োজন হয়। সিনিয়র জুনিয়র মিলে তারা দশজন অফিসিয়াল কাজে বাইরে যায়। যাওয়ার দিন সেঁজুতির একটু জ্বরজ্বর মনে হচ্ছিলো,কিন্তু নীলকে যেতেই হবে,অফিসের কাজ টিকেট পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্য সময় হলে সেঁজুতি বায়না ধরতো নীলকে থেকে যাওয়ার,কিন্তু সেদিন চুপচাপ ছিলো। সে যে নীলকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দিতে চলেছে,যা শুনলে নীলকে ধাক্কা দিয়েও ট্যুরে পাঠানো যাবে না। তার চাইতে ভালো কাজ শেষে ফিরে এলেই নীল সারপ্রাইজড হোক,অনেক অনেক আদর লুটে নিবে সে।

নীল চলে গেলো ঠিকই তার আর সারপ্রাইজ পাওয়া হলো না। সেবার দেশের বাইরে কাজ, মিটিংয়ের শেষের দিন তাদের গাড়িটা ভয়াবহ দূর্ঘটনার শিকার হয়।বেশ কয়েকজন গুরুতরভাবে ইনজুরিতে পড়ে। দুয়েকজন পঙ্গু হয়ে ফিরে। কিন্তু না ফেরার দলে থেকে যায় নীলের নাম। সেঁজুতি এই খবরটা মেনে নিতেই পারেনি,

কোথা থেকে কী হয়েছিলো সে জানে না। কতদিন মানসিক কোমাতে ছিলো তাও বুঝেনি সে। যখন মানসিক ভারসাম্য ফিরে আসে তখন তার পেটে নীলের ভালোবাসার দলিল,এবং অস্তিত্বের নয় মাস। কদিন পরেই কোল জুড়ে এলো নীলাঞ্জনা। ঐ ছোট্ট মুখটাতে হুবহু নীলের মুখটা যেন বসানো।

নীলের অফিস থেকে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পায় সে, পরে নিজেও একটা চাকরি যোগাড় করে নেয়। আজ মেয়ের বয়স দশ বছর। সেঁজুতির মা-বাবা,নীলের পরিবার অনেক চেয়েছিলো তাকে নতুন করে সংসারী করার। কিন্তু তার একটাই কথা নীল এভাবে উধাও হতে পারে না,তাকে ফিরতেই হবে। এমন করেই দশটা বছর পার করে দিলো। চিঠিবক্সটাও শূন্যতায় হাহাকার করতো। সেঁজুতি ভাবতো,নীলের স্মৃতি নিয়েই এমন এক জনম অনায়াসে পাড়ি দেয়া যায়।

কিন্তু এই অবেলায় কে চিঠি লিখবে তাকে! এমন কেউ তো নাই তার। আনমনেই নীলখাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে সেঁজুতি। একটা পরিচিত হাতের অক্ষর,কী মায়া পুরো চিঠি জুড়ে। শুধু লেখা “কাল ঝুম বরষায় একগুচ্ছ কদম হাতে আসবো,দরজায় টোকা দিতেই নীল শাড়ীতে তোমায় দেখি যেন। অপেক্ষায় থেকো পাগলী আমার।” 

সেঁজুতি অপ্রস্তুত হয়। কে সে!কী চায় আমার কাছে! আমি যা ভাবছি তা কী সত্যি! কাল মানে তো আজই,চিঠিটা তো গতকালই এসেছিলো।বৃষ্টির বেগ বেড়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে ধরণী,কোথাও ভিজে উঠছে ঊষর মরুভূমি।

মেয়েটা দুপুরে শুয়েছে এখনও ঘুম বিছানায়। কী পবিত্র লাগছে তাকে। কপালে চুমু দেয় সেঁজুতি। তারপর কালবিলম্ব না করে সেঁজুতি লম্বা আঁচলে একটা নীল শাড়ী জড়িয়ে নেয় গায়ে,ক-গাছি নীল চুড়ি,কপালে নীল টিপ,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, এলোচুল হাত খোঁপাতে বেঁধে নেয় সে।

আয়নাতে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয় সেঁজুতি। কার জন্যে এত দিন পর নিজেকে সাজালাম! কতদিন এমন করে নিজেকে দেখিনি! এই সাজ তো নীলের পাগলামোর জন্যে সাজতাম আমি! তবে আজ…

কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠে সেঁজুতি। কী হতে চলছে তার সাথে! সত্যিই কী নীল ফিরে এসেছে!দৌড়ে দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে,অপলকে তাকিয়ে দেখে তারই নীল দাঁড়িয়ে দরজায়। নীলের ডাকে আবারও চমকে উঠে সে, “কী ঘরে ঢুকতে বলবে না!”

সেঁজুতিকে বুকের উষ্ণতায় টেনে নেয় নীল। শুধু বলে, “পঙ্গু আমিটাকে তোমার থেকে আড়াল করতেই দশবছর লেগে গেলো। আমার যে,ভয় ছিলো খুব প্রিয়াকে হারানোর। আর কিছু জিজ্ঞেস করো না প্লিজ। বাকি সব কটা নীলখামের চিঠিবক্সটা দিয়ে দিবে তোমায়। আর সাক্ষী হিসেবে পাবে নোটন ভাইকে যিনি আমাদের সেদিনের সফরসঙ্গী ছিলেন। যাকে তোমাদের দৈনিক খবর দেয়ার জন্যে অনুরোধের ঢেকুর গিলিয়েছি। হুম সেই নোটন ভাই যে তোমার চাকরি পেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমার নীলাঞ্জনা কোথায়! কোথায় আমাদের ভালোবাসা!”

লেখা : ঊর্মি চৌধুরী

কভার মডেল: জেমী সুলতানা