কানিজ বিথী
দরজার ওপাশ থেকেই অনুর চলে যাওয়ার পায়ের আওয়াজ পায় রফিক। অনু চলে যাচ্ছে তবুও দরজা না খুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে রফিক। বুকের ভেতর কোনো ভাঙনের শব্দ নেই, খোলা জানালা দিয়ে মায়াবী রাতের তীব্র জ্যোৎস্না ঢোকার কোনো তাড়া নেই। শুধু একরাশ নিস্তব্ধতা রফিকের চারপাশ জুড়ে।ভাবলেশহীনভাবে আরও কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে পিছুটান নেয়। ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসে। কর্ণার টেবিলে সিগারেট পড়ে আছে। ধরাবে কিনা ভাবতে ভাবতেই ওর আর অনুর হাস্যোজ্বল ছবিতে চোখ আটকে যায়।
অনু! অনু! অনু! এমন মুখ গোমড়া করে ছবি তুলছো কেন? একটু হাসো। অনু হেসে লুটোপুটি খায় রফিকের বলার ভঙ্গিতে। রফিক কপট রাগ করে বলে অল্প হাসলেই চলবে ম্যাডাম। আচ্ছা অল্প হাসির প্র্যাকটিস করবো । এখন এসব ছবি তোলা বাদ দাও। আর রেডি হও, সময় নেই অফিস যেতে হবে। অনুর তাড়ায় রফিক রেডি হতে থাকে। রফিক অনুর সংসার। লাল- নীল রঙধনুর সংসার। এই সংসারের প্রতিটি কোনায় ওদের ভালোবাসার স্পর্শ। বিশ্বাস হাতের সাথে হাতের আঙ্গুলে লেপ্টে থাকে। সেই লেপ্টানো বিশ্বাস নিয়েই তারা গত আড়াই বছর যাবত একসাথে বসে নির্ঘুম রাত জাগে- কখনো রবি বাবুর গানকে সঙ্গী করে, কখনো গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে আবার কখনো নিঃসঙ্গ চাঁদের আভাতে।
রফিক অতীত থেকে ফিরে আসে। সিগারেট ধরায়, অনুকে কোনো অবস্থাতেই মনে আর ঠাঁই দেবে না এই প্রতিজ্ঞা করতে করতেই সিগারেট থেকে একগাদা ধোঁয়া ভর্তি রুম, ঘুমহীন চোখকে সঙ্গী করে ভোর হওয়া দেখে রফিক।
আজ বারোটায় অনুর ফ্লাইট। ও চলে যাচ্ছে দু বছরের জন্য জার্মানিতে। কি একটা স্কলারশিপ পেয়েছে, ওখানকার খুব নাম করা একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গতমাসের কোনো এক অলস দুপুরে ডাকপিয়ন চিঠিটা দিয়ে যায় অনুকে। কাকতালীয়ভাবে রফিকও সেই দুপুরে বাসায় ছিলো। অনু চিঠি খুলেই জোরে একটা চিৎকার দেয় র- ফি – ক আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। রফিক ওই ছোট্ট এক চিলতে কাগজে অনুর স্বপ্নকে দেখে কিছুটা থমকে যায়। ওর খুশিতে ছোট্ট করে শুধু ‘হুম’ বলে চুপ হয়ে যায়। হঠাৎ রফিকের নিস্তব্ধতায় পুরো ঘরটাই হঠাৎ বেশি রকমের শান্ত হয়ে যায়।
রফিক তুমি খুশি হওনি? না – রফিকের স্পষ্ট অথচ দৃঢ় ” না ” বলাটা অনুর খুশিতে চুড়ি ভাঙার শব্দের মতো হুটোপুটি খেয়ে মেঝেতে দৌড়ায়। জানালার শার্সিতে রোদ সরে মেঘ জমে। কথারা হঠাৎ ফুরিয়ে যায়। অনু কি বলবে বুঝতে পারছিলো না ওই মুহুর্তে। তবুও গলা নামিয়ে বলে, রফিক তুমি তো জানো এটা আমার জন্য কতবড় একটা অর্জন। আমি তোমার সহযোগিতায়, তোমাকে পাশে নিয়ে শেষ করতে চাই আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। আকুল কন্ঠে বলতে থাকে, প্লিজ আমায় না কোরো না। মাত্র তো দুটো বছর দেখতে দেখতে চলে যাবে।
রফিক কিছু না বলে রুম ছেড়ে চলে যায়। ঘরের দেওয়ালগুলো যেন চারপাশ থেকে একটু একটু করে অনুর দিকে এগিয়ে আসছিলো, দৌড়ে শ্বাস নেয়ার জন্য অনু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তীব্র কান্নায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয় বিসর্জনের স্রোতে। আহা! অনু ভেসেই যায় সে স্রোতের টানে। কোথাও এতটুকু শক্ত কোনো মাটি নেই, পাথর নেই যা ওকে আটকে রাখবে। তীব্র কান্নায় অনু খড়কুটোর মতো ভেসে যায়, যেতে থাকে। রফিক একটাবারও আসেনি অনুর মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে। অনু সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই একই জায়গায় ঠায় বসে থাকে। তারপর নিজেই ধীরে ধীরে উঠে রফিকের কাছে যায়, রফিক আমি ঠিক করেছি যাবো।
রফিক ওর যাবো শব্দের পরিবর্তে হুট করে অনুর গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে একবার বলেছি – না তো না ই, ওটা আর হ্যাঁ হবে না। অনু রফিকের থাপ্পড়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিনের পরের সময়টুকু শুধু বিভীষিকার মধ্য দিয়েই গেছে অনু এবং রফিকের জন্য। অনু বহুভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে রফিককে, কখনো ভালোবেসে, কখনো ঝগড়ায়, অভিমানে। কিন্তু রফিকের না এক মুহূর্তের জন্যও হ্যাঁ হয়ে ওঠে নি। ওর এক কথা – অনু যেতে হলে যাও আমি বাধা দেবো না, তবে তোমার এই যাওয়াই হবে শেষ যাওয়া। এখানে এই ঘরে আমার কাছে তুমি আর কোনোদিন ফিরতে পারবে না।
অনু পারেনি রফিককে রাজি করাতে। রফিকের দৃঢ় না যেন ঘরের দেয়ালে, ছবির ফ্রেমে, টিভির স্ক্রিনে, চায়ের কাপে, সবুজ ক্যাকটাসে জাঁকিয়ে বসে থেকে ওকে বারবার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় । ঘরের যে কোনায় হাত রাখে সেখানেই ছোট অথচ কতোটা তীব্র এক ” না ” অনুকে ঘুণপোকার মতো কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অনু ঘর ছাড়ে, রফিক ওকে ফেরায় না। রফিকের নির্লিপ্ততা অনুকে বুকের ভেতর ছুরির ফলার তীক্ষ্ণতায় শুধুই ক্ষত – বিক্ষত করে যাচ্ছিলো। গাড়ীতে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে অনু। ওর চোখের পানিতে হাতের সাথে হাতের লেপ্টানো বিশ্বাসও অস্পষ্ট হতে থাকে একটু একটু করে।
তুলনার সুতা টানছিলো ও। সমঅধিকারের আপ্রাণ চেষ্টায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়েই গেলো ওর সকল বিশ্বাস। এই কটা দিন রফিকের কাছে নিজেকে সঠিক প্রমাণের কি প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করে যাচ্ছিলো অনু। কিন্তু ওর সেই প্রচেষ্টা রফিকের মন গলাতে না পারলেও অনুর ভেতরটাকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছিলো। অনু বোঝেনি সে পারবে না, সবটা পেরে ওঠার সমাজে অনু এখনও প্রবেশ করে নি। রফিকের সাথে জীবন ও জীবিকার ঠান্ডা লড়াইয়ে অনু শুধু ওর ব্যক্তিত্বটুকুই ধরে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু অনুর ব্যক্তিত্ব যে রফিকের জন্য দিন দিন বড্ড অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিলো।
গাড়ীর জানালার শার্সিতে চোখ রেখে অনু রফিকের ” না ” কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে। আনমনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে। রফিক আমার নীরবতা, আমার কষ্ট, আমার চলে যাওয়া এতো সহজে মেনে নিলে? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে নাই তোমার?
রফিক তুমিও জাতিস্মরের চিহ্ন মগজে গেঁথে নিয়ে মুখোশী দিন পার করছিলে। এতটুকু বদলাও নি তুমি। সেই প্রাগৈতিহাসিক আদিমতাকে বুকের ভেতর লালন করে ছিলে। তাই তো তোমার কথার জিভে বিষ ঝরতো, জিতে যাওয়ার লোভে তোমার রাগ, জিদ, কন্ঠস্বরের ওঠানামায় ঘরের প্রতিটা কোন কেঁপে উঠতো। নিজেকে থামাতে পারো নি, শুধু আমাকে থামানোর সমস্ত চেষ্টা একনাগাড়ে করে গেলে। রফিক একটাবার হ্যাঁ বলে নিজেকে প্রমাণ করতে। আমাদের ভালোবাসা, লেপ্টানো বিশ্বাসকে জিতিয়ে দিতে। কেন পারলে না তুমি সব নিয়ে সব দিয়ে সমর্পনের শক্তিতে আমাকে বেঁধে রাখতে। কেন পারলে না আদিম পুরুষত্বকে জয় করে একটা বার আমার হয়ে উঠতে।