ঊর্মি চৌধুরী
সুখ!
তুমি এসেছিলে ডাল চালে আধপ্লেট গরম খিচূড়ীতে,
পেটে পুরে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া সারাবেলা।
তুমি ছিলে, টিনের কৌটোয় মায়ের জমানো খুচরো পয়সাগুলি,
মাঝ দুপুরে ভাইয়ের হাওয়ায় মিঠা খাওয়ার বায়না,
একদফা দাবি,
অবশেষে মুখে অমৃতের স্বাদ, রাজ্যজয়ের খুশি।
তুমি হয়ত লেইসফিতার ডাকে বোনের উচ্ছ্বাসে দৌড়,
মায়ের আঁচল ধরা মিছে আদুরী কান্না, দর কষাকষি,
ক’গুছি লাল নীল চুড়ির ঝনঝনানি।
তুমি ছিলে,মলিন কাপড়ে স্কুলের বেঞ্চিতে বসা
উদাস ছেলেটির নিত্য উৎকণ্ঠা,
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বোর্ডে টাঙানো খুঁজে পাওয়া ছোট অক্ষরের রোল নম্বর,
উত্তীর্ণের কার্ড।
তুমি,সন্ধ্যের আঁধার ছুঁই ছুঁই শেষবেলা,
ঘামে ভেজা গামছা কাঁধে, ক্লান্তির হাসি মাখা মুখে
বাবার ঘরে ফেরা,
সাথে কিছু সদাইপাতি,
ললাটে খুব বেশি ভাগ্য খেলে গেলে সেদিন না হয়,
চকচকে কাগজে মোড়ানো দুটো লেবেনচুস।
সারাদিন অপেক্ষার পর উনুনের আগুনে মায়ের উজ্জ্বল মুখ,কৃতজ্ঞতার হাসি।
তারপর, ছেঁড়া কাঁথায় মুড়িয়ে আঁটসাঁট বিছানাতে স্বস্তির ঘুম।
এই তো ছিলে তুমি সুখের সংজ্ঞাতে,আর কী চাই!!
শান্ত কুঁড়েঘর,মায়ামাখা ক’টা মুখ,
আগামীর শক্তি সঞ্চয়ের ব্যস্ততায় ক্লান্তিরা ফিরে যায়
ঘুমের রাজ্যে,
একচালা ঘরের ফাঁকে জোছনাকুমারী লুটোয়ে পড়ে,
ওপাশের দালানের দেয়াল বেয়ে নেমে আসে
রঙিন রোশনাই,
কখনও ঝিঁ ঝিঁ পোকা হয়ে স্বপ্নেরা কানে ডাক পাড়ে,
ঘুমোতে দেয় না…।
ও পাড়াতে এত তাড়াতাড়ি আঁধার নামে না,
রাত আসেনা, চল দেখবি আয়…
দুটো ঘুমঘুম চোখ বেরিয়ে পড়ে তন্দ্রার পাখায় চড়ে।
এত উজ্জ্বল আলোতে, এ পাড়াতে বুঝি তন্দ্রা ডাকে না,
রাত্রি ঘুমোয় না!!
তালগোলে মেশানো অচিন বাজনাতে মাথা দোলাচ্ছে
উঠতি তারুণ্যের সবুজ চোখ,
জোয়ান পেশির টান।
কালো কাঁচের ফাঁকে ফাঁকে আনাড়ি লেনাদেনা।
দেখি,চায়ের দোকানের সেদিনের ছোটো চুলের বাবলুর
মাথার পেছনে মোরগ ঝুটির ইতিহাস,
ঠোঁটে নিকোটিনের ধোঁয়া তুলে কথায় কথায় ভুলভাল
ইংরেজিতে হাঁক ডাক!
নিয়নের আলোতে নিউরণে মারাত্মক ক্রিয়া বিক্রিয়া,
ক্ষণিকের বিকল মস্তিষ্ক,
এ যেন বিনা টিকেটে লটারি জিতে যাওয়া।
জোছনা গলা রূপোলি আলো খেলে না আজ মেঝেতে,
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে পর্দার ওপাশে,
দেখি না স্বর্গ থেকে নেমে আসা মায়াবী হাসির ফোয়ারা,
লেইসফিতার বাক্সে চুড়ির রিনিঝিনি শুনি না বহুদিন,
সুখ পাখি এখন আর আমার দাওয়ায় ডাকে না,
তন্দ্রার পাহাড়ে আমায় খুঁজে নেয় না কেউ।
কচকচে মোহের উটকো ঝাঁঝাঁলো গন্ধে উবে গেছে শুকনো বকুলের ঘ্রাণ।
আমি…রাত খুঁজি,ওম খুঁজি।
ভেজা গামছায় গন্ধ শুঁকি,
খুঁজি চকচকে কাগজের লেবেনচুসের মোহময়ী সুগন্ধ,
পাই না।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে,তন্দ্রার ঘোরে,চুরি হয়ে গেছে ঘুম।