শায়লা শবনম
কাদম্বরী দেবী ছিলেন বাঙালি নাট্যকার, সম্পাদক, চিত্রশিল্পী, ঠাকুরবাড়ির উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌদি, যাকে তিনি ডাকতেন নতুন বৌঠান বলে। তাঁর আসল নাম মাতঙ্গিনী গঙ্গোপাধ্যায়, ঠাকুর পরিবারের বউ হয়ে আসার পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে তিনি হয়ে যান কাদম্বরী দেবী। ঠাকুরবাড়ির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এটা ছিল অন্যতম, তারা পরিবারের ছেলেদের বিয়ে করাতেন নিজেদের চাইতে নিচুস্তরে। ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে নিজেদের সমমর্যাদার হিন্দু সমাজ ঠাকুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী ছিল না। ফলে তারা নিজেদের চাইতে নিচু পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে বাধ্য হতেন। কিন্তু বিয়ের পরে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবারের নতুন সদস্যদের নাম বদলে দিতেন। এভাবেই মাতঙ্গিনী গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে যান কাদম্বরী দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ভবতারিণী হয়ে যান মৃণালিনী দেবী।
কাদম্বরী দেবী’র পিতা শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার। নয় বছর বয়সে ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে আসেন কাদম্বরী দেবী। কিন্তু চাকর শ্রেণির শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা হওয়ার কারণে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তিনি যথাযথ সম্মান পেতেন না। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদুষী স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী কাদম্বরীর বিরুদ্ধে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের বিদ্বেষ উসকে দিয়েছিলেন। ফলে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে অপাংক্তেয় হয়েই ছিলেন কাদম্বরী। তাই পরিবারের ছোটদের সাথেই তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্বামীর ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বয়সে কাদম্বরীর দু’বছরের ছোট। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় নতুনদার স্ত্রী বলে কাদম্বরীও হয়ে ওঠেন প্রিয় নতুন বৌঠান।
নাটক, জাহাজের ব্যবসার কাজে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যস্ত থাকায় রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন কাদম্বরী দেবীর একমাত্র খেলার সাথী, গল্প-আড্ডার সঙ্গী। কখনো কখনো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরী- এই তিনজনের আড্ডা বসত। এই আসরের তারা নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দনকানন’। কখনো কখনো সেকালের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক, নাট্যব্যক্তিত্বদের আড্ডা বসত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাড়িতে, যেখানে কাদম্বরী দেবীও আলোচনায় অংশ নিতেন। সেই সময়ের কোনো নারীর জন্য এটা সাহসিকতার ছিল বৈকি।
শুধু তাই নয়, কাদম্বরী ‘ভারতী’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সাহিত্যে বিশেষ রুচি রাখতেন। এ ব্যাপারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সবসময় তাকে উৎসাহিত করতেন। এমনকি কাদম্বরীকে সাথে নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে যেতেন হাওয়া খেতে। এ নিয়ে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে এবং সমাজে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়, যা কাদম্বরীর উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরী বিভিন্ন সময়ে গঙ্গাতীরের বিভিন্ন বাগানবাড়িতে বসবাস করেছেন। প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গী হতেন। কাদম্বরীর অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাধনা তখন তুঙ্গে। নতুন বোঠান ছিল রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনার প্রথম পাঠক, সমালোচক এবং অনুরাগী। তাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অনেক গল্প, কবিতা, গান। অনেক গ্রন্থ, কবিতা, গানও কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের চরিত্র না হয়েও কাদম্বরী দেবী তাই রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে উজ্জ্বল এক চরিত্র।
তবে অন্তর্মুখী চরিত্রের কাদম্বরী দেবী ছিলেন ভীষণ রকম নিঃসঙ্গ। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের পরে তিনি আরও নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত হন। নিঃসন্তান কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের সাথেই অতিবাহিত করতেন অনেকটা সময়। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসা আর নাটক নিয়ে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার ছিল না। তাই সমবয়সী রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন কাদম্বরীর কথা বলার, গল্পের সঙ্গী। ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে হলে অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কাদম্বরী। এরপর স্বর্ণময়ী দেবীর কন্যা ঊর্মিলার দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ঊর্মিলার মৃত্যু হলে ভীষণরকম ভেঙ্গে পড়েন কাদম্বরী। নিঃসন্তান এবং দুঃসাহসিকতার জন্য সমালোচিত হওয়ার সাথে নতুন করে যুক্ত হয় ঊর্মিলার মৃত্যু। ফলে ভীষণরকম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন কাদম্বরী। ঊর্মিলার মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন তিনি। নিঃসঙ্গতা, অবসাদ আর সমালোচনার চাপে শেষ পর্যন্ত আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরেও প্রায় চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু তিনি আর বিয়ে করেননি, রাঁচির নিঃসঙ্গ পাহাড়ে বসে মগ্নতায় নিমজ্জিত করেছিলেন নিজেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে পরিচিত তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। তাঁর মৃত্যু যে রবীন্দ্রনাথকে কতটা আহত করেছিল, তা তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ের এক জায়গায় খুব স্পষ্ট করেই লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,
‘আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়।….. সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল….. জীবনের আর কোথাও যে কিছু মাত্র ফাঁক আছে, তাহা তখন জানিতাম না; সমস্তই হাসিকান্নায় নিরেট করিয়া বোনা। তাহাকে অতিক্রম করিয়া আর কিছুই দেখা যাইত না, তাহা একেবারে চরম করিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলাম।’
রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে একবার বলেছিলেন, ‘মৃতের বয়স বাড়ে না, চেহারা পালটায় না, চরিত্র বদলায় না, তাই আত্মীয়দের অনুভবও পালটায় না। ভালোই হয়েছে নতুন বৌঠান চলে গেছেন তার অবিনশ্বর মধুর ছায়া রেখে, তাই তাকে নিয়ে আজও কবিতা লিখছি। নতুন বৌঠান যেমন ছিলেন তেমনই আছেন, বেঁচে থাকলে হয়তো মামলা মোকদ্দমা হত।’ (রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে- মৈত্রেয়ী দেবী)
মন্তব্যটি করার কারণ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীকে জড়িয়ে সে সময়ে অনেক সমালোচনা করা হয়েছে, লেখা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। রবীন্দ্র-বিদ্বেষীরা কাদম্বরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের স্নেহময় সম্পর্কটাকে নোংরামির ছাঁচে ফেলে রবীন্দ্র চরিত্রকে একেবারে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে সমালোচনায় জর্জরিত করে ফেলতেন। এই আক্রমণের জবাব দিয়ে রবীন্দ্র জীবনীগ্রন্থ রচয়িতা অশোক ভট্টাচার্য ‘কবিমানসী’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘আমাদের পারিবারিক জীবনে সমবয়স্ক দেবর ও ভ্রাতৃবধূর যে-সম্পর্ক স্বভাবতই অতি মধুর, রবীন্দ্রনাথের জীবনে তা মধুরতম রূপ নিয়েই দেখা দিয়েছিল ; এবং রবীন্দ্রনাথের সারস্বত সাধনায় তা নিগৃঢ় প্রেরণারূপে ক্রিয়াশীল হয়েছিল। বস্তুত, কাদম্বরী দেবীর প্রতি তরুণ রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ানুরাগই তাঁর জীবনের গভীরতম উপলব্ধি এবং কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুই রবীন্দ্র-জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’
কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করে বেশকিছু কবিতা ও গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘লিপিকা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ‘কৃতঘ্নশোক’, ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’, ‘একটি দিন’, ‘প্রথম শোক’ কাদম্বরী দেবীকে স্মরণ করেই লেখা। ‘শৈশব সঙ্গীত’ এর উৎসর্গে লেখা আছে, ‘এ কবিতাগুলোও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।’ কাদম্বরী দেবীকে নিয়েই তিনি লিখেছিলেন,
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ঐ যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,
ঐ যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী,
গ্রহ তারা রবি
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি।
নয়নসম্মূখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই!
নয়নের মাঝখানে নতুন বৌঠানকে ঠাঁই দিয়ে যে কবিতা, গানগুলো রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে তা সমৃদ্ধ করেছে। তাই সাহিত্যিক বা সাহিত্যের চরিত্র না হয়েও কাদম্বরী দেবী অমর হয়ে আছেন।
তথ্য সূত্র: (পরস্পরাহীন রবীন্দ্রনাথ-আবদুশ শাকুর, রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে- মৈত্রেয়ী দেবী, প্রথম আলো-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।)
( ছবি: সংগৃহীত)
খুব ভাল লাগলো আপা