শাহনাজ মুন্নী
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে বিছানায় মাযহারের গা ঘেঁষে শুয়ে চোখ বুঁজে রাজিবের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে স্বর্ণা। মনে হয়,যদি মাযহার এখন আমার মনের কথা পাঠ করতে পারতো, যদি দেখতে বা শুনতে পেতো, যদি বুঝতে পারতো আসলে আমি মনে মনে কার কথা ভাবছি, তাহলে?
ভাগ্যিস, আল্লাহ-তালা মানুষকে সেই ক্ষমতা দেয় নাই। দিলে জগৎ সংসারে কি যে অনর্থ ঘটতো, তা ভেবে ভয়-ই লাগে ওর। স্বর্ণা ডান পাশে কাৎ হয়ে নিজেকে মাযহারের কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে। আর তখনই মাযহার ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, ‘কই যাও?’ স্বর্ণার মনে হয়, আসলেই তো কোথায় যাচ্ছে সে, মাযহারের কাছ থেকে দূরে, বহু দূরে কোন পাতালপুরিতে?
মুখে বলে, ‘কই আবার যাবো? এই তো তোমার পাশেই আছি।’ মাযহার চোখ বন্ধ করেই অন্ধের মতো হাত বাড়ায়। ঘুমের মধ্যেও স্বর্ণাকে চাই তার। ‘হাতাপাতা’ করার জন্য। ‘হাতাপাতা’ স্বর্ণার বানানো শব্দ, ঘুমের মধ্যেও মাযহারের ওর শরীর হাতড়ানোর অভ্যাসটাকে আদর করে এই নামেই ডাকে স্বর্ণা। পেটে, পিঠে, বুকে, পাছায় সবখানে মাযহারের হাত বুলানো চাই। স্বর্ণা বাঁধা দেয়না।সে গড়িয়ে এসে মাযহারের বুকের উপর পড়ে।
রাত বাড়ছে, ঘুমাতে হবে, কালকে সকালে অফিস, তবু ঘুম আসে না স্বর্ণার। মাযহার তার ‘হাতাপাতা’ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছে, মৃদু নাক ডাকছে তার। স্বর্ণার আবার রাজিবের কথা মনে পড়ে। সে’ও নিশ্চয়ই এখন ইলোরার পাশে শুয়ে আছে বা ঘুমিয়ে আছে বা স্বপ্ন দেখছে বা স্বর্ণার মতোই জেগে আছে, ভাবছে স্বর্ণার কথাই।
আর ইলোরা হয়তো ওর গাঁ ঘেষে শুয়ে থেকেও সেটা টের পাচ্ছে না। রাজিবের’ও কি স্বর্ণার মতো অপরাধবোধ হয়? মনে হয় সে তার স্ত্রীকে ঠকাচ্ছে?
‘নাহ। অপরাধবোধ কেন হবে? ঠকানোরই বা কি আছে? .. বরং আমি মনে করি ও আমাদের সম্পর্কের বেনিফিট পায়।’
‘কিরকম?’
‘আমি যখন তোমার সঙ্গে থাকি, সময় কাটাই, গল্প করি, তখন আমার মন ভাল থাকে, আমি বাসায় গিয়ে ইলোরার সঙ্গেও তখন ভাল ব্যবহার করি। আবার কখনো কখনো, ও যেন কোন কিছু সন্দেহ না করে, সেজন্য বেশি বেশি ওর কেয়ার করি, ওর প্রতি বেশি ভালবাসা দেখাই, মনযোগ দেই, লাভটা কার হয় বলো ?’
রাজিব দুষ্টুমীর হাসি হাসে। স্বর্ণার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘খামোকা নিজেকে অপরাধি ভেবে কষ্ট পেয়ে না তো, কাম অন, উই ডিজার্ভ ইচ আদার।’ রাজিবের মতো এত’টা নির্ভার থাকতে পারে না স্বর্ণা। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে থাকে তার, একটু নড়াচড়া করলেই খচ খচ করে সেটা খোঁচাতে থাকে।
‘আচ্ছা, ইলোরার সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কোথায়?’ স্বর্ণা একদিন জিজ্ঞেস করলে চশমার ফ্রেমের ভেতর রাজিবের ভ্র কুঁচকে যায়।
‘সমস্যা? … সমস্যা তো নাই।’
‘তাহলে কনজুগাল লাইফে, মানে ফিজিক্যালী… তোমরা কি ওকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কি?’
রাজিব উল্টা প্রশ্ন করে, ‘মাযহারের সঙ্গে তোমার সব ঠিক তো?’
একটু ভাবে স্বর্ণা। হয়তো, সাড়ে ছয় বছরের সংসার জীবনটা দ্রুত পাতা উল্টে দেখে নেয়। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘হুম, সব ঠিক। আসলে মাযহার খুব ভালো।’
‘ইলোরাও ভাল মেয়ে। একটু কড়া টাইপের কিন্তু মনটা নরম।’
তারা দুজন নিঃশব্দে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। রাস্তার পাশের মেহগনি গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। তারপর, কোনদিন হয়তো দুজনে একটা রেস্তোরায় গিয়ে বসে, দুই কাপ কফি নেয়, কফিশপের স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল ভেদ করে রাস্তায় শব্দ করে চলা গাড়ির শব্দ ওদের কানে আসে না, শুধু নির্বাক ছবির দৃশ্যের মতো চোখের সামনে ধুলি উড়িয়ে গাড়ি গুলোর দ্রত ছুটে যাওয়া দেখে দুজন। কফির কাপের সঙ্গে চামচের টুংটাং শব্দ হয়।
‘তাহলে আমাদের সমস্যাটি কি?’
‘মানে?’
‘কোথাও নিশ্চয়ই কোন শূন্যতা আছে আমাদের, কোন হাহাকার, কোন গোপন বেদনা, কোন অপ্রাপ্তি ..’
তারা দুজনেই নিজেদের যাপিত জীবনের পাতাগুলি উল্টেপাল্টে দেখে। স্মৃতি হাতড়ায়। কিছুটা সময় চলে যায়। দুজনেই এক সাথে বলে উঠে,
‘নাহ্; .. তেমন কিছু তো পাচ্ছি না।’
‘তাহলে, কেনো তুমি আসো আমার কাছে, আর,আমি যাই তোমার কাছে? কেন? কি পাই আমরা একে অন্যের কাছ থেকে, যা অন্য কোথাও পাই না।’
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আছে তাদের দুজনের কাছেই, অথবা কারো কাছেই নেই। এইসব প্রশ্ন হয়তো তাদের মধ্যে কখনো উচ্চারিত হয়, আবার হয়তো কখনো হয়ও না।
‘আচ্ছা, এই সম্পর্কের পরিণতি কি? বলতে পারো, কোথায় যেয়ে এটা শেষ হবে?’
‘শুরুতেই শেষের কথা ভাবছো কেন স্বর্ণা? যা হবার তা হবেই হবে, যা পাল্টাবার ঠিক পাল্টাবে’।
স্বর্ণা পাশ ফিরে শোয়। আর তখনই রাজিবের শক্ত লোমশ হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে, ‘তোমার গায়ে অজানা মাছের গন্ধ পাই, মৎস্যগন্ধা, মীনকুমারী।’ স্বর্ণার গায়ে তখন রঙীন চক্কে রূপালী আঁশ গজায়। রক্ত শীতল হয়ে যায়, নিজের পাতলা পাখনা নাড়িয়ে সে সাঁতার কাটে, ফুলকা নাড়িয়ে শ্বাস নেয়, শরীর হালকা হয়ে যায় তার, জলের তোড়ে সে একবার ভাসে আর একবার ডোবে।
রাজিবকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমার গায়ে পুরনো দিঘীর ধূসর শ্যাওলার গন্ধ পাই, আমার কাজল কালো শান্ত দিঘী।’ রাজিবের গায়ে তখন পানি জমে, গাঢ় সবুজ ঘন পানি, তার উপরে দুধের সরের মতো পাতলা শ্যাওলা জমে, দিনে দিনে শ্যাওলা গুলো ঘন হয়, কালচে হয়, মায়াময় হয়। দীঘিটা বলে, ‘আমাতে তুমি ইচ্ছে মতো সাঁতার কাটো রঙীন মাছ।’
স্বর্ণা সাঁতার কাটতে কাটতে পাশ বদলায়। আর মাযহার তাকে বুকে টেনে বলে, ‘রঙীন মাছ, তুমি দিঘীতে কেন? মুক্ত সমুদ্রে সাঁতার কাটো, আমি তোমার নিরিবিলি বঙ্গোপসাগর, তোমার নীল ফেনিল ঢেউ ..’
‘কিন্তু, তুমি যে বড্ড লোনা, বড্ড উত্তাল ! আমি ছোট মাছ, লবণ পানিতে আমার শরীর পচে যায়, আমার চোখ গলে যায়, আমার বাঁচার জন্য চাই মিঠা পানি, চাই শান্ত জল’।
‘তোমার জন্য আমি আমার সব জল বদলে ফেলবো ছোট্ট মাছ, সব লবণ সরিয়ে দেবো, জগতের সব মিঠা পানি নিজের দিকে টেনে আনবো, আমি সমুদ্র, আমি সব পারি।’
সমুদ্রের কথা শুনে কল কল করে উঠে দিঘীর পানি। বলে, ‘ও মিথ্যা বলছে ছোট মাছ, তুমি আমার কাছেই থাকো!’ গর্জন করে উঠে সমুদ্র ‘বদ্ধ দিঘীর কথা শুনো না, ওখানে যেওনা রঙীন মাছ, তুমি আমার মধ্যে থাকো!’
দিঘী আর সমুদ্রের রেষারেষিতে আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। ঝুম বৃষ্টি নামে। স্বর্ণার শরীর থেকে মাছের আঁশ খসে যায়, রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠে, শরীর ভারি হয়ে যায়। তার মৎস্য শরীর ধীরে ধীরে মানবীর শরীরে রূপান্তরিত হলে স্বর্ণার ঘুম ভেঙে যায়। আর তখনো সেই একই প্রশ্ন তার মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে।
‘কেন আমি রাজিবের কাছে যাই? আর রাজিব-ই বা কেন আসে আমার কাছে? বিবাহিত জীবনের ক্লান্তি আর একঘেয়েমী কাটাতে? স্বাদ বদল করতে? বৈচিত্র্য খুঁজতে?’ ‘আচ্ছা, আমি বুঝি না, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কি খুব জরুরী?’
রাজিব খানিকটা অসহিষ্ণু ভঙ্গীতেই জিজ্ঞেস করে। অভিমানী সুরে বলে, ‘দেখো, মনের মধ্যে এতো সংশয়, এতো দ্বিধা নিয়ে তুমি আর এসো না, প্লিজ !’
স্বর্ণা রাজিবকে বুঝাতে পারে না যে জগৎ সংসারের হাজারো কাজের ভীড়ে তার মনের ভেতরে কোন এক উদাস বাউল অহো রাত্রি বাঁশি বাজায়। সেই করুণ বাঁশির সুর যেন কৌতুহল ভরে জানতে চায়, ‘আসলে, তোমরা কি কেউ কাউকে সম্পূর্ণ করে পাও?’
স্বর্ণা পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘সম্পূর্ণ করে কি আসলে কেউ কাউকে পায়?’ বাঁশি এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। স্বর্ণা কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, ‘ না, সম্পূর্ণটা হয়তো পাই না।’ ‘তাহলে?’
রাজিব তো প্রায়ই বলে, ‘সম্পূর্ণ করে পাওয়া একরকমের আনন্দ আবার টুকরো করে, ভাগ করে কিংবা ধরো চুরি করে পাওয়াটা অন্যরকমের আনন্দ।’
‘আনন্দ না উত্তেজনা?’
বাঁশি অবিকল যেন মাযহারের গলার স্বর নকল করে জানতে চায়। স্বর্ণা চমকে উঠে। স্বর্ণা বিব্রত হয়। সে একরকম চিৎকার করে উঠে, ‘জানিনা। জানতে চাই’ও না। বাঁশি তুমি থামো। তোমার এইসব বোকা বোকা প্রশ্ন করা থামাও। অন্য কোন সুর বাজাও। অন্য কোন কথা বলো।’
বাঁশি তখন মাযহারের মতোই হা হা করে গা দুলিয়ে হাসে। স্বর্ণার খুব ভয় করে। কোন আঁধার অতল গহ্বরে পড়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর বাজে অনুভূতি হয় তার।দ্রুত হাত বাড়িয়ে কোন অবলম্বন খুঁজে সে, যেন কোন কিছু ধরে নিজের পতন ঠেকাতে চায়।
বাঁশি তখন আশাবরী ঠাটের শুদ্ধ করে না বাজিয়ে কোমল সুরে বাজাতে থাকে, ফলে ঘর জুড়ে ভৈরবি ঠাটের শ্যামল নরম রং উৎপন্ন হয়। ‘সকাল বেলার আলোয় বাজে বিদায় ব্যাথার ভৈরবী। আন বাঁশি তোর, আয় কবি।’
বাঁশির গাওয়া শেষের গানের রেশ, আর সুরের মায়া কানে নিয়ে অতল গহ্বর থেকে নাকি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে আসে স্বর্ণা। সে টের পায় বিনম্র ভঙ্গীতে সূর্য উঠছে, শহরের উঁচু সব দালানের কারণে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার স্নিগ্ধ আলোর নীলাভ শুভ্রতা অনুভব করা যাচ্ছে। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই, দুঃখ নেই, অশান্তি নেই। যত অশান্তি, যত অস্বস্তি সব যেন শুধু স্বর্ণার মনে।
মাযহার বাইরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বর্ণা’ও নিজের ব্যাগ গোছায়।
‘কই যাও?’ মাযহার ক্যাজুয়ালী জিজ্ঞেস করে।
‘নিরুদ্দেশ যাত্রায়।’
মাযহার হাসে, ‘ট্যুর আছে?’
‘হুম!’ স্বর্ণা সংক্ষেপে বলে।
মোবাইল ফোন বেজে উঠে। রাজিবের ফোন। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেলে স্বর্ণা ফোনের সুইচ অফ করে দেয়। নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার সময় কেউ সঙ্গে না থাকলেই ভাল।
শাহনাজ মুন্নী ( কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক)