কাজী শবনম
আমরা কত কনফিডেন্টলি বলি, আমি আমার সন্তানের জন্য আমার বেস্ট এফোর্ট দেই; আমার সন্তান আমার প্রতি খুশি। আসলেই কি সন্তান খুশি? সন্তান আমার ভয়ে খুশি হবার অভিনয় করছে না তো? অথবা আমার সন্তানের স্টাবর্ননেস বা রুড বিহেভিয়ারের জন্য আমার কোন অ্যাক্ট দায়ী নয় তো?
অবাক হলেও সত্যি, চাইল্ড সাইকোলজিস্ট যখন অভয় দেন যে, তার সাথে শেয়ার করা কথা সিক্রেট থাকবে, বাবা মা জানতে পারবে না, তখন বাচ্চাদের অভিযোগ শুনলে শকড হতে হয়। পরে যদি বাবা মায়েরা জানতে পারে (শর্ত সাপেক্ষে, বাচ্চাদেরকে এ নিয়ে কিছু বলবে না), তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।
খুব খুব কমন অভিযোগ, আমার গান/নাচ/আার্ট/কারাতে শিখতে ইচ্ছা করে না কিন্তু বাবা মা আমার কথা শুনতে চায় না। তারা বুঝতেই চায় না সারাদিন স্কুল করে আমার ক্লান্ত লাগে, তারপর প্রাইভেট টিউটর, হোম ওয়ার্ক। আমি রেস্ট নেয়ার সময় পাই না, ঘুমানোর সময় পাই না। অথবা আমার গলায় সুর নেই তাও জোর করে গানের ক্লাসে নিয়ে যায়। কারণ সেটা বাবা/মায়ের ছোটবেলার অপূর্ণ স্বপ্ন!
আরেকটা কমন অভিযোগ, আমার কাছে সায়েন্স কঠিন লাগে, ম্যাথ কঠিন লাগে। ভয় লাগে। কান্না আসে। এই সাবজেক্টগুলোর ভয়ে আমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। বাবা-মা বুঝতে চায় না, আমার হিস্ট্রি ভালো লাগে, ফিজিক্স ভালো লাগে অথবা বাংলা ভালো লাগে। আমার গান ভালো লাগে। কবিতা ভালো লাগে। আমার ক্রিকেট ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে ক্রিকেটার হতে চাই, ডাক্তার/ ইন্জিনিয়ার না। বাবা-মা বুঝতে চায় না; বেতের বারি’তে আমার ব্যথা লাগে… আমার জিদ আরো বাড়ে… বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে… মরে যেতে ইচ্ছা করে (বয়ঃসন্ধিতে)।
চাইল্ড এ্যাবিউজ খুব কমন একটি ঘটনা। এ্যাবিউজার বাইরের কেউ হয় না। হয় কাছের আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধু; যাকে বাচ্চার বাবা-মা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। সেই সুযোগটাই তারা নেয়। মনে রাখতে হবে, নিজের সন্তানের চেয়ে আপন কেউ নাই এবং ‘বাচ্চারা বানিয়ে গল্প বলে’ এই ধারণা মনে পোষণ করা যাবে না। হয়তো বাচ্চা বাবা-মাকে ডিরেক্টলি বা ইনডিরেক্টলি বলেছিলো। উনারা বিশ্বাস করেননি। তারপর বাবা-মায়ের প্রতি রাগ ক্ষোভ ঘৃনা নিয়ে কত সন্তান বড় হয়। এবং সেই চাইল্ড এ্যাবিউজের ভয়াবহ স্মৃতি বাচ্চার এডাল্টহুড ধ্বংস করে দেয়; যদি শৈশব/কৈশোরেই প্রোপার কাউন্সিলিং করা না হয়।
বাচ্চারা বড়দের চেয়ে বেশি বুঝে। অনেক বাচ্চা এত ম্যাচিউর থাকে যে, সে যে বুঝতে পারছে, এটা সে বাবা মাকে বুঝতে দেয় না। যখন আমরা বাবা মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিবো, তখন তার প্রিপারেশন দরকার। নিজেদের লাইফস্টাইলে চেন্জ আনা দরকার। এমনকি নিজেদের আচরণেও পরিবর্তন দরকার।
এবার বাচ্চাদের কিছু আনইউজুয়াল কমপ্লেইন বলি। বাবা মায়ের কাজে যাওয়া বাচ্চারা পজিটিভলি নেয় যদি শুরু থেকে সেভাবে প্রেজেন্ট করা হয় বিষয়টা। কিন্তু কাজের পরের সময়টুকু বা উইকেন্ডে বাচ্চাকে সময় না দিয়ে বাবা/মা নিজেদের বন্ধু বান্ধব, পার্টি, আড্ডা, গেট টুগেদারে ব্যস্ত থাকে এটা বাচ্চার সাইকোলজিতে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। বাচ্চারা নেগলেক্টেড ফীল করে। কোনো বাচ্চা তার ক্ষোভ দেখায় জেদ/চিৎকার করে। কোনো বাচ্চা অন্য দিকে মাইন্ড ডায়ভার্ট করে। বাচ্চা অলরেডী সারাদিন বাবা মাকে পায় না। বাকি সময়টুকু এক্সপেক্ট করাটাই স্বাভাবিক। এই বাচ্চাগুলো বয়ঃসন্ধিতে ভালনারেবল অবস্থায় পড়ে। তখন বাবা মায়ের আর কিছু করার থাকে না।
বাবা-মায়ের এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন। এক সময় না এক সময় বাচ্চারা জানতে/বুঝতে পারে। যদিও বাবা-মাকে বলার সাহস তার নাই; এই দুর্বিষহ স্মৃতি তার এডাল্ডহুড ধ্বংস করে দেয়। সেই বাচ্চা কোনোদিন বড় হয়ে তার হাজবেন্ড/ওয়াইফকে বিশ্বাস করতে পারে না। কারো কারো মেন্টাল সিকনেস এমন পর্যায় চলে যেতে পারে যে, তার হেলুসিয়েশন হতে পারে যে তার পার্টনার অন্য কারো সাথে ডেট করছে। অথচ তার পার্টনারের অন্য কারো সাথে রিলেশনে নেই। অনেকে এই কল্পনার জাল বুনতে বুনতে সুইসাইডও করে।
আমি যেই মানুষ আমার লাইফ আমার বাচ্চাদের জন্য ডেডিকেটেড; আমার ছোট ছেলে আজমাঈনেরও এক সময় অভিযোগ ছিলো আমার প্রতি! কথায় কথায় রাগ দেখাচ্ছিলো সবার সাথে। কেনো কান্না করতো কেউকে বলতো না। আমি স্কুলের কো অর্ডিনেটরকে রিকোয়েস্ট করলাম ওর কাউন্সিলিং করতে। উনি যখন আলাদা করে কথা বলেছিলো আজমাঈনের সাথে; বাচ্চা আমার কথাই বলতে পারছিলো না। অঝোর ধারায় কাঁদছিলো। অনেকক্ষন পর বলেছিলো, “মাম্মা আমান ভাইয়াকে বেশি আদর করে, আলাদা করে বেশি সময় দেয়”।
কো-অর্ডিনেটর যখন আমার সাথে শেয়ার করলো খুব অপরাধবোধ হচ্ছিলো। কিন্তু আমি পজিটিভলি নিয়েছি। তারপর ঠিক করে নিলাম কিভাবে আজমাঈনকেও আলাদা করে কোয়ালিটি টাইম, প্রায়োরিটি দেয়া যায়। কারন আজমাঈনের অভিযোগ সত্যি। যৌক্তিক কারণেই আমার আমানকে বেশি সময় এবং প্রয়োরিটি দিতে হতো; হয়। কিন্তু ও তো ছোট মানুষ। দশবার বুঝলে একবার তো অভিমান হয় ই। হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন শিশুর সুস্থ স্বাভাবিক সুখী বয়:সন্ধিকাল এবং প্রাপ্তবয়স্ক সময়ের জন্য আর্লি চাইল্ডহুডের ভূমিকা অপরিসীম।
কাজী শবনম, আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট আর্টিকেল রাইটার
খুব ভাল লাগল লেখাতা পড়ে।