জেসমীন আক্তার
ইফতার প্রায় শেষ পর্যায়ে। টিভিতে রান্নার একটি অনুষ্ঠানে একজন পুরুষ শেফ নতুন আইটেমের একটা রান্না তৈরি করার প্রণালি দেখানোর মুহূর্তে আমার বড় ছেলে আবীর (২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী) নিজে নিজেই বলে যাচ্ছিল, “মেয়েরা রান্না করে কিন্তু বড় বড় রেস্টুরেন্টের শেফ হয় ছেলেরা”।
“আবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মেয়েরা ফার্স্ট হয় কিন্তু বড় বড় ডাক্তারও হয় ছেলেরা”।
সামনেই বসা আমার ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে প্রভার ভ্রু-দুটো সামান্য কুঁচকে যাওয়ার দৃশ্যটি আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি।
ছেলের কথায় তাৎক্ষণিকভাবে আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো…
আসলে তুমি যেভাবে ভাবছো,ব্যাপারটা সেরকম নয়। মেয়েরা রান্না করে ঠিকই কিন্তু বড় বড় হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্টের শেফ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে, পরিবারের সাপোর্ট বেশির ভাগ সময় থাকে না বললেই চলে।
বড় বড় ডাক্তার মেয়েরাও হয়, হয়তো সংখ্যায় কম। মেয়েরা নিজ মেধা, অধ্যবসায়, চেষ্টা দিয়ে এগিয়ে যায় ঠিকই। একটা সময় পরে সামাজিক দায়বদ্ধতা, সময়, পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সমস্যা, স্বাধীনতার অভাব ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার কারণে সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না।
তুমি আমাকেই দেখ, সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করে এসএসসি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে, একটা সময় দেখলাম আমাদের এলাকায় সায়েন্সের ভাল কোনো শিক্ষক নেই উপরের ক্লাসগুলোতে পড়ানোর মতো। কোনো মতো টেনে-টুনে নিয়ে গেলাম আরও কিছুদূর একা একাই পড়ে। কারণ দূরে কোচিং করতে যাওয়া কিংবা কোনো স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়ার মতো পারিবারিক সাপোর্ট বা পারমিশন আমার ছিলনা।
একটা সময় আইন নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। তখন তোমার মামা মানে আমার ভাই আপত্তি জানালো, এই পেশাটি নাকি তার পছন্দ না।
কোনো মতো মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম, তোমাদের দুই ভাই-বোনের জন্ম হলো। আবার মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।
তোমার বাবাকে ব্যাংকে চাকরির ইচ্ছের কথা জানালাম, ভর্তি করিয়ে দিল এমবিএ’তে, যেন চাকরিটা পাওয়া সহজ হয়।
দুই বছরের কোর্স কমপ্লিটও করলাম কিন্তু চাকরি করাটা আর হয়ে উঠলো না, তোমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হলো।
ভাবলাম, আর যাই হোক তিন বাচ্চা অন্যের কাছে রেখে এমন দীর্ঘ সময়ের চাকরি করাটা কোনভাবেই সম্ভব হবেনা তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম।
একটা স্কুলে চাকরি নিলাম, তাও বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের রাস্তা, যেন তোমাদের দেখাশোনাটা ঠিক মতো করতে পারি,কোনো সমস্যা বা প্রয়োজন হলে দৌড়ে আসতে পারি।
আমার ছেলে-মেয়ে দুজনই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এই মুহূর্তে আমিই ছেলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, তাহলে তুমি যা ভেবেছো তা কি ঠিক?
ছেলে ‘না’ সূচক মাথা নেড়ে যাচ্ছে। মেয়ের চোখে একটা নীরব বিজয়ের ঝলকানি দেখা গেল।
মেয়ে বলে উঠলো “গত পরশু আমাদের কোচিংয়ের স্যারও বলছিলেন, ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম হয় মেয়েরা কিন্তু বড় ডাক্তার ছেলেরাই হয়”।
আমি বললাম, হুম বলুক, বড় ডাক্তার হওয়ার জন্য যে প্র্যাকটিস, রিসার্চের প্রয়োজনে সময় ও সুযোগের দরকার হয় তার অনেকটাই একটা মেয়ে সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারনে সেই সময়টা পায়না।
অবশ্যই মেয়েটির অদক্ষতা কিংবা অযোগ্যতার কারণে নয়। যদি কেউ পর্যাপ্ত সাপোর্ট দেয়ার থাকতো তবে অবশ্যই মেয়েরাও পারতো সমানভাবে। আর এ সকল প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অনেক মেয়েই বড় ডাক্তার হচ্ছে।
একটি মেয়ে অনেকগুলো দায়িত্ব নিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে দৌঁড়ায়, কেউ স্বপ্নকে ছুঁয়ে দিতে পারে, কেউ পারে না। সে অন্য কারো স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হয়।
ছেলেটাকে দেখলাম একেবারে চুপ হয়ে গেছে। মেয়েটি আরও কথা শোনার অপেক্ষায়…
আমি শুধু মেয়েকে বললাম,তুমি টেনশন করোনা, মা আছে তোমার পাশে।
জেসমীন আক্তার, (শিক্ষক) ওয়েস্ট ধানমন্ডি ইউসুফ হাই স্কুল