কাজী শবনম
আমার বাচ্চারা যখন অনেক ছোট ছিলো, অক্ষর জ্ঞান হয়নি, তখন আমি ছবিসহ গ্রসারি লিস্ট বানাতাম ওদের জন্য। মুরগি, মাছ, ডিম, দুধ, ফল, সবজির ছবি এঁকে ওদেরকে রং করতে দিতাম। সেইম দুইটা গ্রসারি লিস্ট দুই ছেলের জন্য। তারপর ওয়ালমার্টে নিয়ে বলতাম, এই লিস্টের জিনিসগুলো খুঁজে এনে শপিং কার্টে রাখো। বাচ্চারা কি যে খুশি হতো! ওরা শুধু শপিং লিস্টের জিনিসই কার্টে তুলতো, দুই চোখে যা দেখতো, সব তুলে শপিং কার্ট ভরে ফেলতো না।
যখন লন্ড্রি করতে যেতাম, লন্ড্রি বাস্কেটটা আমি নিতাম। ওদেরকে ডিটারজেন্ট, কয়েন এইসব হালকা ওজনের জিনিসপত্র দিতাম। সাথে করে কালারিং চক নিতাম। মেশিনে কাপড় দিয়ে ঐ এক ঘন্টা বাচ্চাদের সাথে নীচে বসে খেলতাম। বাচ্চারা কালারিং চক দিয়ে স্ট্রিট ড্রয়িং করতো।
ঘরের সব কাজে ওদের ইনভলভ করতাম। শুকনো কাপড় ভাঁজ করা হোক আর ডাইনিং টেবিল ক্লিন করা অথবা কুকিং, বেকিং সব কিছুতেই বাচ্চাদের ইনভলভ করতাম। বাচ্চারা খুশি হয় এসব করতে।
আমাদের বাসায় কখনো টিভি ছিলো না, মানে রাখতাম না। ট্যাবও না। ল্যাপটপ থেকে ঘড়ি ধরে সময় পেতো ইউটিউবে যাওয়ার। মোবাইল ফোন টাচ করা তো একেবারেই যাবেনা। ওরা জানে মোবাইল ফোন কাজের জিনিস, খেলার জিনিস না।
আমরা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। সেখানে লাইব্রেরিতে সকালের দিকটায় বাচ্চাদের জন্য স্টোরি বলার একটা সেশন হতো, পাপেট শো হতো। এলাকার বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে একটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতো। সেখানে ছোট্ট বাচ্চারাও লাইব্রেরির মেম্বার হতে পারে! তাদের নামেও লাইব্রেরি কার্ড ইস্যু হয়! তারাও কার্ড স্ক্যান করে বই, সিডি আনতে পারে। চিলড্রেন সেন্টার থাকে; যেখানে বাচ্চাদের বয়স অনুযায়ী আলাদা আলাদা প্লে জোন থাকে। প্যারেন্টরাও বাচ্চাদের সাথে খেলা করে।
আর একটু পর পর পার্ক। আমাদের কমপ্লেক্সের পার্কে একটা কিডস জোন ছিলো, বাচ্চাদের জন্য ছোট সুইমিং পুল ছিলো। বিকেল হলেই আমরা মা-ছেলেরা সাইকেল নিয়ে পার্কে চলে যেতাম। বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইম দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
যতটুকু চাইল্ড সাইকোলজি পড়েছি, স্পেশাল এডুকেশন নিয়ে জেনেছি যদি কোনো বাচ্চা জেদি বা একরোখা হয়, বুঝতে হবে তার ভালোবাসার প্রয়োজন। বকা দিলে, শাস্তি দিলে সে আরো একরোখা হবে এবং বয়সের সাথে এটা বাড়তে থাকবে। এক সময় সে একজন জেদি ও একরোখা নারী বা পুরুষ হয়ে উঠবে।
যদি ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকাই, সবুজ ঘাসের দিকে তাকাই, সাগরের দিকে তাকাই মনে হয়না এই ছোট্ট জীবন খুব সিম্পলি শান্তিতেও পার করা যায়? জীবন তখনই সুন্দর হয়, যখন আমরা জীবনকে সুন্দর করতে চাই। আমরা আধুনিক হতে গিয়ে কোথায় গিয়ে যে ঠেকছি, একদিন আমাদেরকে এর মাশুল দিতে হবে। তাই আমরা যত আধুনিকই হই না কেন বাচ্চাদের বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। তারা যেন নিজের ভাল-মন্দটা বুঝতে শিখে সেভাবেই বড় করে তুলতে হবে। আর বাবা-মায়েরাই হয়ে উঠতে পারেন তাদের আইডল। প্যারেন্টসদের আচরণের প্রভাব বাচ্চাদের ওপর পড়ে। ওরা ছোট, কিছু বুঝবেনা এরকমটি ভাবা মোটেও চলবেনা। অনেকসময় ওরা বড়দের চেয়ে বেশি বুঝে।
ইউরোপ, আমেরিকা যেখানে আবার পরিবারের দিকে ঝুঁকছে, কাউন্সেলিং করে ফ্যামিলি ভ্যালু শিখাচ্ছে, ফ্যামিলি বন্ডিং এর ওপর জোর দিচ্ছে, সেখানে যেন আজকাল আমরা ফ্যামিলি ফেলে বাইরে ঝু্ঁকছি! কিন্তু মনে রাখতে হবে আজ বাচ্চাকে সময় না দিলে, কাল সেই বাচ্চা আমাকেও সময় দিবে না। এটাই কি স্বাভাবিক না? সময় দেয়া বলতে শুধু মাঝে মধ্যে আয়োজন করে ফ্যামিলি ট্যুরে গিয়ে “হ্যাপী ফ্যামিলি” ছবি পোস্ট দেয়া না, তাদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা। অনেক কিছু কিনে এনে তাকে দিচ্ছেন, ভাবছেন এতেই সে খুশি। কিন্তু বিষয়টি মোটেও এরকম নয়, এতে হয়তো সে সাময়িক খুশি হচ্ছে। কিন্তু আপনার দেয়া সময়, কেয়ারিং, পজিটিভ আচরণ এসবই বাচ্চার ওপর প্রভাব রাখবে সবচাইতে বেশি।
কাজী শবনম, আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট আর্টিকেল রাইটার