0

বাঙালির খাবার

Share

নূর কামরুন নাহার

বাঙালি রসনাপ্রিয়। অভাব, দরিদ্রতা, জীবন সংগ্রাম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই অঞ্চলের মানুষকে নানাভাবে বির্পযস্ত করে রাখলেও এখানে মানুষের সাথে সাথে মানুষের আত্মীয়তা ও আন্তরিকতার বন্ধন দৃঢ়। তাই বাঙালি সবকিছুর পরেও অতিথিপরায়ণ। বাঙালির এই খাবার তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনাচারণের সাথে যুক্ত। যুক্ত এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বিন্যাস ও মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের ওপর এবং তার কৃষ্টি ও নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের ওপর। বাঙালির এই ভোজনপ্রিয়তা, আপ্যায়নপ্রিয়তা নিয়ে নানা সাহিত্য রচিত হয়েছে, প্রচলিত আছে নানা রসের গল্প। আসুন, দেখি সেগুলো কেমন।

বাঙালির প্রধান খাবার কী?

এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই যে কথাটি আসে তা হচ্ছে মাছে-ভাতে বাঙালি। ঈশ্বর গুপ্ত বলেছেন, ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল’। আবার বৈষ্ণব কবি বলেছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ তাই বলা যায়, বাঙালির একটা প্রধান খাবার ভাত। মাছ বাঙালির এক প্রিয় খাবার। বাঙালির মাছপ্রীতি কবে থেকে শুরু হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, নদ-নদী আর খাল-বিলের অঞ্চল বঙ্গদেশে মাছ বোধহয় আদিকাল থেকেই খাওয়া হতো। এর প্রমাণ হিসেবে বলা হয়, অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর আর ময়নামতিতে যেসব পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে তার অনেকগুলোতেই মাছের ছবি আছে। বাংলা খাবারের সবচেয়ে পুরনো বই পাক রাজেস্বর প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শতকে। তারপর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাক-প্রণালী। এই দুই বইয়ে মাছ রান্নার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী তার রান্নার বইয়ে মাছের আটান্ন রকমের রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

সেকালের সাহিত্যেও মাছের বিচিত্র নাম এবং মাছের বিচিত্র রান্নার বর্ণনা পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে মাছের রান্নার একটি বর্ণনা এ রকম, সর্ষের তেলে চিতল মাছের কোল ভাজা, কুমড়ো বড়ি আর আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল, আদারস দিয়ে সর্ষে তেলে কই মাছ ভাজা, কাতলা রমাছের ঝোল, খরশোলা মাছ ভাজা আর মোল মাছের কাঁটা বের করে কাঁচা আমের সাঙ্গে রান্না। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলেও আছে বিভিন্ন মাছের রান্নার বিবরণ, যেমন, রুই মাছ দিয়ে কলতার আগা, মাগুর মাছ দিয়ে গিমা গাছ, ঝাঁঝালো কটু তেল দিয়ে রান্না খরসুন মাছ, ভেতরে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে বাইরে সুতো জড়িয়ে চিড়িং মাছের মাথা, চিতল মাছের কোল ভাজা আর কৈ মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল।

বাঙালি হিন্দু সমাজে বিধবাসহ আরো কারো কারো মাছ-মাংস খাওয়ার ব্যাপারে বাছবিচার থাকায় সবজি ও নিরামিষের চলও ছিল। নিরামিষ রান্নার মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য এনেছিল বাঙালি গৃহবধূরা। সেকালের সাহিত্যে লাফরা চচ্চরি, মরিচের ঝোল, মোচার ঘণ্ট, মোচা ভাজা, কুমড়োর বড়ি, ভর্তা ইত্যাদির উল্লেখ দেখা যায়। গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮০-এর দশকে তার রিয়াজ-উস-সালাতীনে লিখেছেন, এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত, সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ করে। লাল মরিচ এবং লবণ তাদের পছন্দ। তারা আদৌ গম বা যবের রুটি খায় না। ঘিয়ে রান্না খাসি বা মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।

ডাল বাঙালির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার। এই ডাল খাবার ইতিহাসও বেশ পুরনো। চর্যাপদে যদিও ডালের উল্লেখ নেই কিন্তু কয়েকশ বছর পরে লেখা মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে ডালের উল্লেখ দেখা যায়। ডাল আর ভাত ছিল নিন্মশ্রেণির মানুষের খাবার। চন্ডীমঙ্গল ছাড়াও মধ্যযুগের সাহিত্যে নানা প্রকার ডাল যেমন ফুটকলাই, মুসুর, মাষ, মুগ এবং ছোলার ডালের উল্লেখ আছে। মাষ ডাল গ্রামের আপ্যায়নে এখনো অনেক গুরুত্ব বহন করে। বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠান ও মেহমান আপ্যায়নে মাষের ডাল খাওয়ানো হয়।

শাক বাঙালির অনেক আদিকালের একটি খাবার। এটিও নিন্ম আয়ের লোকেরা খেত। তবে যারা নিরামিষভোজী ছিল তারাও শাক খেত। চৈতন্যচরিতামৃতে চেতন্যদেবের জন্য তার মায়ের বিশ প্রকারের শাক রান্নার উল্লেখ পাওয়া যায়। চৈতন্যচরিতামৃত এবং অন্যান্য কাব্য থেকে যেসব শাকের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল অঢ়্যুতা, কলমী, নটে, নালিতা, নিম, পটোল, পাটশাক, পালং,পুঁই, পোর পাতার শাক, বেতাগ, বেনাতি, লাউয়ের ডগা এবং হেলেঞ্চা।

মিষ্টি বাঙালির চিরদিনের প্রিয় এক খাবার। প্রাচীন কাল থেকেই এ অঞ্চলে মিষ্টির প্রচলন ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যে নানা রকম মিষ্টির নাম দেখা যায়। গোপাল হালদার ঠাট্টা করে এক জায়গায় বাঙালি সংস্কৃতিকে রসগোল্লা আর সন্দেশের সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। রসগোল্লার প্রচলন কবে থেকে শুরু হয় তা জানা যায় না, তবে ইংরেজ আমলের আগেই রসগোল্লা ছিল। রসগোল্লা থেকে আরো নানা স্বাদের মিষ্টির প্রচলন ঘটে, যেমন রাজভোগ, স্বরাজভোগ, কমলাভোগ, রসগোল্লার চাটনি, রসমালাই, দানাদার, ক্ষীরমোহন, চমচম, কালাজাম, পান্তোয়া ইত্যাদি।

বাঙালির আর এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম পিঠা। পিঠার সাথে বাঙালির মিষ্টান্নপ্রিয়তার কথাও উল্লেখযোগ্য। যেসব পিঠা, মিষ্টি ও মিষ্টান্ন সেকালে জনপ্রিয় ছিল তার মধ্যে ছিল অমৃতগুটিকা, জাঞ্জবড়া, খিরিসা, ক্ষীরপুরি, ঘোল, চন্দ্রপুলি, চন্দ্রকান্তি, ছানাবড়া, ছেনা, দই, দুগ্ধকুষ্মাণ্ড, দুগ্ধচিঁড়া, দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ লকলকি, নারিকেল পুলি, নালবড়া, পাতপিঠা, পানা, পায়েস, পিঠা পেঁড়া, বেসারি, এন্ডা, মনোহরা ইত্যাদি। খেজুরের রস ও গুড় বরাবরই বাঙালির খুব প্রিয় একটা খাবার। খেজুরের গুড়ের সাথে চালের গুঁড়ো, নারকেল, দুধ এসবের মিশ্রণে বিভিন্ন সুস্বাদু পিঠা আবহমান কাল থেকে বাঙালির প্রিয় এক খাবার।

জিলাপিও বাঙালিদের একটি প্রিয় মিষ্টি খাবার। শহরে যেমন এটি পাওয়া যায়, তেমনি গ্রামে মাষের ডালের সাথে চালের গুঁড়ার মিশ্রণে জিলাপি পিঠা বানানো হয়।

এছাড়া শুকনো খাবারের মধ্যে চিঁড়া, মুড়ি, খৈ, মুড়কি ইত্যাদিও বহু পূর্ব থেকেই দেখা যায়। বিভিন্ন রকমের নাড়ু–ও খুব মুখরোচক একটা খাবার। যেমন চালের নাড়ু,– নারকেলের নাড়ু–, মুড়ির নাড়ু–, তিলের নাড়ু।

একসময় গ্রামে বেশ ছাতু খাবার প্রচলন ছিল। চালভাজা, গমভাজা, চিঁড়াভাজা, মুড়ি ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু আর পুষ্টিকর এই ছাতু। আবার শুধু চালের বা গমের ছাতুও প্রচলিত ছিল। ছাতুর সাথে চিনি ও দুধ মিশিয়েও খাওয়া হত।

বাঙালির খাবারের তালিকায় রয়েছে নানা রকম ফল। ফলাহার বলে বাংলায় একটি শব্দই রয়েছে আলাদা করে। আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, পেয়ারা, কামরাঙা, জাম্বুরা, ডালিম, নারিকেল, কুল, কলা, খেজুর, তাল, পানিফল, বেল, আমলকী ইত্যাদি ফল বহু আগে থেকেই এ অঞ্চলের ফল হিসেবে বেশ উল্লেখযোগ্য। সময়ের বিবর্তনে বাঙালির ফলের তালিকায় এসেছে আপেল, আনার, মালটা কমলা, নাশপাতি, আঙুর, ইত্যাদি। আমের কথা সাহিত্যে বহুবার এসেছে। ভাত, মুড়ি, চিঁড়া, খৈয়ের সাথে আম, দুধ আর চিনি মিশিয়ে খাওয়াও বাঙালি ঐতিহ্যের একটা অংশ।

দুধ আর দই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় খাবারের নাম। দুধ অনেকের কাছেই প্রতিদিনের বাধ্যতামূলক খাবার ছিল। তরকারি দিয়ে ভাত খাবার পর দুধ দিয়ে ভাত খাওয়া অনেকের প্রিয় এক অভ্যাস। আদিকাল হতেই ধনী-দরিদ্র সবার কাছে দই খুবই আদরণীয় একটি খাবার। গ্রামের যেকোনো অনুষ্ঠানে এবং অতিথি আপ্যায়নে দই একটি আবশ্যক খাবারের নাম।

বাঙালির খাবার তালিকায় নানা রকম কাসুন্দি ও আচারের দেখা পাওয়া যায়। নানা রকম কান্সুদির কথা মধ্যযুগের সাহিত্যে দেখা যায়। যেমন, আমের কাসুন্দি, আদার কাসুন্দি, ঝাল কাসুন্দি। বহু রকম আচারের মাধ্যমে খাবারের স্বাদ বাড়ানো। আচার বাঙালির খাবারের তালিকায় খুব প্রিয় এক নাম।

বাঙালির রান্নায় আবহমানকাল ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে মশলা। বাঙালি মশলাযুক্ত খাবার খেতে পছন্দ করে। আদিকােেল ব্যবহৃত মশলার মধ্যে রয়েছে আদা, জিরা, ধনে, এলাচি, মৌরি, কর্পূর, লবঙ্গ। টকজাতীয় রান্নায় ব্যবহার করা হত আমশি, আমচুঢ়, আমড়া, আমলকী, আমের চটা ইত্যাদি।

বাঙালির খাবারে মুসলমানদের প্রভাব

মধ্যযুগে বাঙালির এক অংশের খাবারে এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের প্রভাব বেশ উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। বহিরাগত বাদশা, নবাব, আমীর ওমরাহ এবং পারস্য, উত্তর ভারত ও কেন্দ্রীয় এশিয়া থেকে মুসলমানেরা রান্নার ঐতিহ্য নিয়ে এসেছিলেন। ঠিক কখন থেকে মুসলমানদের খাবার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির হয়ে ওঠে, জানা না গেলেও উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঈশ্বর গুপ্ত পোলাও আর কালিয়ার কথা বলেন। মোগলাই খাবার পোলাও-বিরিয়ানি, কোরমা, কারিয়া, কোপ্তা, মুসল্লম ইত্যাদি বাঙালির খাবার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পেঁয়াজ আর রসুন খাবার প্রচলনও করে মুসলমানেরা। মুসলমানেরা তরমুজ ও খরমুজ এনেছিল। বাঙালি খাবারে পর্তুগিজ এবং ইংরেজরাও প্রভাব ফেলেছে। পর্তুগিজরা বাঙালির খাবারে দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যোগ করে। আরু আর লঙ্কা বা মরিচ। আনারস, আতা, কাজু বাদামও তাদের সংযোজন। সম্ভবত পাউরুটিও তারাই এনেছিল। পাউরুটি, বিস্কিট, চপ, কাটলেট, পেটিস ইত্যাদি ইংরেজরা এনেছিল।

আপ্যায়নের খাবার

আমার বাড়ি যাইও ভ্রমর বসতে দেব পিঁড়ে, জলপান করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে। অতিথিকে ভাগ্যলক্ষী হিসেবে কদর করে তাকে আপ্যায়ন করা বাঙালির মজ্জাগত। এই আপ্যায়নে শহরে এবং গ্রামের মধ্যে প্রার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত গ্রামের অতিথি দূর থেকে আসে বলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাতে অবস্থান বা বেশি সময় থাকে বলে গ্রামে মূলত দুপুরে বা রাতের খাবার মাধ্যমে অতিথি আপ্যায়ন করানো হয়ে থাকে। অতিথিকে পোলাও, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, মাছ, ডাল দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। অতিথি আপ্যায়নে দুধ, গাছের ডাবও প্রচলিত। ঘরে পাতা দই অতিথি আপ্যায়নের একটি জনপ্রিয় খাবার। অতিথি দুই-তিন দিন অবস্থান করলে তাকে বিভিন্ন পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বিশেষ করে শীতের সময় নতুন চালের পিঠা দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। গাছের ফল দিয়েও আপ্যায়ন করা হয়।

শহরে অতিথি আপ্যায়ন মূলত নানা মুখরোচক নাস্তার মাধ্যমে করা হয়। শহরের আপ্যায়নে কচুরি, নিমকি, পুরি, মোগলাই পরোটা, শিঙারা, সমুচা, নুডুলস, বার্গার, পেটিস, বিস্কিট ইত্যাদি নেনতা ও ঝাল খাবার এবং সেমাই, ফিরনি, পায়েস, হালুয়া, পুডিং, কাস্টার্ড, কেক, প্রেস্ট্রি ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় খাবার দেখা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন মিষ্টি, পিঠা, ফল ও নানা পদের নাস্তা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। অতিথি আপ্যায়নে পানীয় পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে চা আর কফি। গরমে শরবত এবং বর্তমান সময়ে বাজারে বিভিন্ন বেভারেজের কোল্ডড্রিংকস দিয়েও আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে।

মেহমানকে দুপুরে বা রাতের খাবারের দাওয়াত দেয়া হলে সাধারণত পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি পোলাও, ইলিশ পোলাও, তেহারি, কাবাব, কোপ্তা, কোরমা গরুর মাংসের নানা পদ, খাসির মাংসের নানা পদ, মাছের নানা তরকারি, ডিমের নানা পদ ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। পোলাও বিরিয়ানির পাশাপাশি চাল আর ডাল মিশিয়ে রান্না করা খিচুড়িও একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবারে পরিণত হয়েছে। খিচুড়ি তৈরিতেও নানা প্রকার মাত্রা যোগ করা হয়েছে। মূল খাবারের পর মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের প্রচলন বহু পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে।

উৎসব

বাঙালি যেমন আপ্যায়নপ্রিয় তেমনি উৎসবপ্রিয়। বারো মাসে তের র্পাবণের একটি প্রবাদ এই অঞ্চল ঘিরেই প্রবর্তিত। সুযোগ পেলেই বাঙালি তাই মেতে ওঠে উৎসব- আনন্দে। এসব উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ খাবারের আয়োজন। বাঙালির এই উৎসব আর খাবারের আয়োজনকে মোটাদাগে তিন ভাগ করা যায় :

১.ধর্মীয় উৎসব, ২. সাংস্কৃতিক উৎসব, ৩. পারিবারিক উৎসব।

মুসলমানদের বড় দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল ফিতর ও ঈদ উল আজহা। দুটো উৎসবেই খাবার হিসেবে আয়োজন করা হয় মিষ্টান্ন, যেমন সেমাই, জর্দা ফিরনি, পায়েস আর মূল খাবার হিসেবে পোলাও, কাবাব টিকিয়া, বিরিয়ানি, কোরমা রোস্ট, গরুর মাংস, খাসির মাংস ইত্যাদি। কোরবানির ঈদে যেহেতু সবার বাড়িতেই প্রচুর মাংস থাকে, তাই মাংস দিয়ে করা হয় নানা পদ। এই দুটো বড় উৎসব ছাড়াও মুসলমানদের অনেকে মহররম বা আশুরার দিন খিচুড়ি-মাংস রান্না করে গরিবদের দিয়ে থাকে। নিজেরাও খায়। শবে বরাতে অনেকেই গরিবদের হালুয়া- রুটি দেয় এবং নিজেরাও নানা প্রকার হালুয়া যেমন বুট, গাজর, পেঁপে, বাদাম, সুজি ইত্যাদির হলিুয়া বানিয়ে থাকে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব হচ্ছে দুর্গাপূজা। তারপর রয়েছে কালিপূজা, লক্ষীপূজা ইত্যাদি। পূজার মূল খাবার হচ্ছে কলা ও আতপ চালের মিশ্রণে নৈবেদ্য, ফল ও মিষ্টান্ন। এছাড়া ভোগের জন্য করা হয় লুচি ও মিষ্টান্ন লাবড়া। খিচুড়িও করা হয়। লক্ষীপূজায় তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রকার নাড়–। কালিপূজায় অনেকে খায় বলির পাঠার মাংস। বাঙালি সারা বছর পালন করে নানা সাংস্কৃতিক উৎসব।

যে উৎসব সকল বাঙালির সর্বজনীন বলে গণ্য হয়েছে, সেটি হচ্ছে পয়লা বৈশাখ। নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে এ দিনটি পালন করার ধারণা সম্ভবত ইংরেজদের কাছ থেকে এসেছে। ঈশ্বর গুপ্ত ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু বাংলা নববর্ষের উল্লেখ করেননি। তা থেকে বোঝা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একটি উৎসব হিসেবে বাংলা নববর্ষ পালন হত না। হালখাতার কথা সুবল মিত্রের অভিধানে নেই। কিন্তু ১৯১৫ থেকে ১৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত যোগেশচন্দ্র রায়ের বাঙ্গালা শব্দকোষে আছে। হালখাতা সীমাবদ্ধ ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। জমিদার বা প্রজা আর ব্যবসায়ী-খদ্দেরের গন্ডির বাইরে বাংলা নববর্ষকে ঘটা করে বরণ করার ইতিহাস একেবারেই নবীন। অনেকের ধারণা, ১৫৮৪ সালে আকবর ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করেন এবং সেই থেকে বাংলা নববর্ষ উৎসবের শুরু।

( তথ্যসূত্র: মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশের উৎসব; মোহান্ত, বাংলাপিডিয়া)

এ কথা স্বীকার করতেই হবে, পহেলা বৈশাখ গত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এদিন দোকানে দোকানে হালখাতা খোলা হয়। কাস্টমারদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। এদিনে আবার বাংলা সংস্কৃতিতে পান্তা ইলিশ খাওয়ার একটা নতুন ধারা যোগ হয়েছে। যদিও এই পান্তা ইলিশ খাওয়া নগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং বাঙালি কৃষ্টির কোনো অংশ নয়। তবে পহেলা বৈশাখে বাড়িতে বাড়িতে ভালো রান্না হয়। শহর এলাকায় ইলিশ কেনার ধুম পড়ে। ইলিশের নানা পদ করা হয়। যেমন সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ, ইলিশ পোলাও। তবে পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতির কোনো ইতিহাস দেখা যায় না। আজকাল অনেকেই পোলাও-মাংস এবং ভালো খাবার রান্না করে। তবে পহেলা বৈশাখে দই-মিষ্টি খাওয়া হত। পহেলা বৈশাখের আগের দিন চৈত্রসংক্রান্তি পালন করা হয়।

এছাড়া পৌষসংক্রান্তি পালন করা হয়। নবান্ন বাঙালি সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব। নবান্নে নতুন চালের পিঠা বানানো হয়। পায়েস-ফিরনি বানানো হয়। মুসলমানেরা আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পারিবারিক অনুষ্ঠান বিয়ের অনুষ্ঠানে পোলাও, কাবাব, টিকিয়া, বিরিয়ানি, কোরমা, রোস্ট, জর্দা, ফিরনি খাওয়া হয়ে থাকে। তবে হিন্দু আর মুসলমানদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে কিছু প্রার্থক্য রয়েছে। যেমন,

মুসলমানদের একটি পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে মুসলমানির উৎসব। গ্রামে এটি অতি আনন্দ আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। এই মুসলমানি উপলক্ষে চিঁড়া, মুড়িসহ নানা প্রকার পিঠা বানানো হয়। সাত দিন ধরে ঐ বাড়িতে উৎসব চলত। যাকে মুসলমানি করানো হয় তার জন্য নানা রকম পিঠা, নাস্তা, কলসি ভরে মামাবাড়ি থেকে চিঁড়ামুড়ি পাঠানোর একটা চলও রয়েছে অনেক এলাকায়। এখনও বাংলাদেশের গ্রামের বহু অঞ্চলে এটা দেখা যায়। সাত দিন পর মুসলমানি যাকে করানো হয় তাকে গোসল করানো একটি বড় আনন্দ উৎসব। নানা রকম গানে করে, হলুদ আর মেহেদি মেখে গোছল করানো হয়। ঐ দিন বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সার্মথ্য অনুযায়ী আত্মীয় , প্রতিবেশী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়াত দেয়া হয়। গরু, খাসি জবাই করে অনুষ্ঠান করা হয়। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও পোলাও- মাংস, মাছ, দই, মিষ্টি; আবার কোথাও মাংস, ভাত, মাছ, মাষের ডাল, দই দ্বারা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। উপহারের বিনিময়ে অতিথিরা এই দাওয়াত খেয়ে যায়।

হিন্দু পরিবারে উপনয়ন একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান। এখানে মাছ, মাংস, ভাত, ডাল, দই, পোলাও-মাংস খাওয়ানো হয়।

উপসংহার

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে বাঙালির খাবার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই খাবারের সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। তেমনি জড়িয়ে আছে নিত্যদিনের বন্ধন, আপনজনের সাথে প্রিয় মুহূর্তের অনুভব আর সুখ-দুঃখের কথকতাও। বাঙালিকে যেমন তার নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য দ্বারা আলাদা করা যায় তেমনি তার রসনা দিয়েও তাকে চিহ্নিত করা যায় স্বতন্ত্র এক জাতি হিসেবে।

নূর কামরুন নাহার ( কবি ও কথাসাহিত্যিক)