0

পোশাকে ফিউশন

Share

হালকা শেডের কিংবা প্রিন্টের বা ছোট মোটিফের লম্বা কলার দেওয়া টি- শার্ট, সাথে একটা পালাজ্জো কিংবা ডিভাইডার। পোশাকে এমন ফিউশনের কথা শোনে আজকের দিনে অফিস আওয়ারের কথা মনে হলেও হতে পারে, কিন্তু এটি ছিল বাংলাদেশে সত্তর-আশির দশকের সিনেমার একজন জনপ্রিয় নায়িকার পোশাক। পোশাকের নিত্যনতুন ঢংয়ের যে বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখছি, চোখ-কান খোলা রেখে যদি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, তবে আপনি বলতে বাধ্য, হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ। তবে ভিন্নতা কিন্তু আছে। পোশাকের ধরন এক হলেও তার ফ্যাশন কিংবা স্টাইলটা আলাদা। ফ্যাশনের আলাদা বৈচিত্র্য আর সময়ের চাহিদা একসাথে সমন্বয় করে পোশাকের ফ্যাশনের ধারায় বিবর্তন আসে। বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে বাংলাদেশের পোশাক কেমন ছিল? এক্ষেত্রে প্রশ্নটা খুব ভ্যালিড। ফ্যাশনের এ ধারায় যখন গণমাধ্যম একটি অন্যতম ধারা তখন আমরা দেখি গণমাধ্যম যে রাষ্ট্রচিন্তার কিংবা ব্যক্তিচিন্তার ধারাবাহিকতা বহন করে পোশাকের ব্যঞ্জনা ঠিক তেমনই হয়। ধরুন ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমার কথা। সিনেমার নায়িকার পোশাকে দেশজ ঐতিহ্যের চিত্র। এক প্যাঁচে পরা তাঁতের শাড়ি কিংবা সুতির খাটো কলারের শর্ট পাঞ্জাবি, এসব কিন্তু দেশজ ঐতিহ্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার দেশের বিবদমান প্রেক্ষাপট বোঝাতে  সুতির বদলে জর্জেট বা ভেলভেটের চটকদার পোশাকের এন্টাগনিস্ট বা প্রোটাগনিস্ট সে সময়ের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা কিন্তু অনেকটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের ফ্যাশনে এখন নতুন নতুন অনেক ট্রেন্ড যুক্ত হয়েছে। কিংবা বলা যায়, ফ্যাশন ভাবনায় বর্তমানে যুক্ত হয়েছে নতুন ফিউশন। আশির দশকের রেট্রো ফ্যাশন কিংবা নব্বইয়ের দশকের হাল আমলের ফ্যাশনের প্রভাব সবটাই এখনকার ফ্যাশনে নতুন করে যুক্ত হয়েছে। তরুণদের ফ্যাশন চিন্তা অন্য সব যুগের ফ্যাশন চিন্তক কিংবা ফ্যাশন আইকনদের চেয়ে যে আলাদা তা স্বীকার করতেই হবে। বিশ্বায়নের যুগের পাশ্চাত্য চিন্তাধারা আর পূর্বতন ফ্যাশন আইকনদের ফ্যাশন চিন্তার নতুন ধারার সাথে অপূর্ব সমন্বয় আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। হয়তো অনেকে বলতে পারেন, এ ফ্যাশন চিন্তা বুঝি এক গোলমেলে চিন্তার জগাখিচুড়ি। কিন্তু ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীর এই তারুণ্যনির্ভর ভাবনা বাংলাদেশের ফ্যাশনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। হাল আমলের ফ্যাশনে এখন যেমন পাশ্চাত্যের ছোঁয়া লেগেছে।

আর সেই ফ্যাশনকে আধুনিক ফ্যাশন ডিজাইনাররা সাজিয়ে তুলছেন দেশীয় ঢংয়ে। পোশাকেই যেন লেগেছে নবচেতনার বাহার। তরুণ কিংবা মধ্যবয়সী সবার কাছেই এখন দেশীয় কাপড়ে তৈরি বিদেশি ঢংয়ের পোশাকের মর্যাদা লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের খ্যাতনামা ফ্যাশন হাউজগুলোকে অবশ্য এ আলোড়ন তৈরির ক্রেডিট দেওয়া যেতেই পারে। হঠাৎ করে বাংলাদেশের মানুষের পোশাক চিন্তায় দেশীয় ঐতিহ্যের চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তারা সুচারুরূপে পালন করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফ্যাশন চিন্তায় দেশীয় ধারার মধ্যে আধুনিক ফিউশন তৈরির কারিগর কিন্তু দেশের বাইরের নামীদামি ফ্যাশন ডিজাইনাররা নন। দেশীয় মোটিফ থেকে নতুন নতুন আইডিয়া বের করে দেশীয় কাপড়ে নতুন পোশাকের ট্রেন্ড ফ্যাশনের ধারায় আমাদের দেশের ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউজগুলোর অবদানকে কোনোভাবে পরোক্ষে রাখার উপায় নেই।

আধুনিক সময়ের কিংবা বর্তমান প্রজন্মের চিন্তায় এখন শুধু একঘেয়ে পোশাকে আটকে নেই। বরং এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন যুগের মাত্রা। তাদের পোশাকের তালিকায় এখন দেখা যায় শাড়ি, সিঙ্গেল কামিজ, থ্রিপিছ সহ নানা কাটিংয়ের টপসের চল। যার বেশির ভাগই দেশীয় কাপড়ের কিংবা দেশীয় ফ্যাশন ডিজাইনারদের তৈরি পোশাক। পোশাকে আধুনিকতা আনতে এখন আর বিদেশি পোশাকের প্রতি অত্যধিক ঝোঁক চোখে পড়ে না। বরং তার জায়গায় এখন দেশের ফ্যাশনের নতুন ডিজাইনকে প্রাধান্য দেয়। সামাজিক ভাবধারা অক্ষুন্ন রেখে হাল আমলের বিশ্ব কিংবা যুগোপযোগী ফ্যাশন আমাদের দেশের পোশাক শিল্পকে শুধু দেশের গন্ডির ভেতরে নয়, বরং দেশের বাইরেও তৈরি করছে নতুন ট্রেন্ড। আর উৎসবমুখর বাংলায় পোশাকের নতুন ধারা সব সময়ই ছিল বলা চলে।

দেশের উৎসবে আমরা এখন নতুন ট্রেন্ডের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ দেখতে পাই, যার বেশির ভাগই থাকে দেশি ঢংয়ের। সুতি শাড়ির সাথে এপলিকের কাজ কিংবা কাঁথা সেলাইয়ের শাড়ি বা ভিন্ন ভিন্ন কনট্রাস্টের শাড়ির চল বর্তমানের ফ্যাশনেও চলে এসেছে। দেশীয় আভিজাত্য ধরে রাখতে যেসব ফ্যাশন হাউজ মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তাদের মধ্যে আড়ং, বিশ্বরঙ, কে ক্র্যাফট,বিবিয়ানা, দেশাল সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান। পাশ্চাত্য ধারার কিউব মোটিফ কিংবা রাংতা মোটিফের বদলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নকশি বুনন, ঐতিহ্যবাহী মাটির ডিজাইনগুলোকে একীভূত করে তৈরি করছে ফ্যাশনের নতুন আবহ। ফ্যাশনের বৈচিত্র্যে নতুন কিছু যদি আসে তবে এটাই বলা চলে। দীর্ঘদিন ধরে হারাতে বসা এসব জিনিস শুধু মোটিফ ব্যঞ্জনাতেই যে ফিরে এসেছে তা নয়, কাপড় বুননে আর ফ্যাশনে এনেছে অনন্যতা। জর্জেট কিংবা শিফনের বেইজে অলরেডি ফিউশন আমরা দেখতে পাচ্ছি। কাতান-জামদানি, ব্রোডার, সামুসিল্ক আর জর্জেট ফিউশন প্রতিটি জিনিসই এক্সক্লুসিভ মাত্রা যোগ করছে। তবে পোশাকের এতো বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও আমরা কোথায় যেন এখনো আটকে আছি।

উৎসবমুখর বাংলায় পোশাকের বৈচিত্র্য উৎসবের দিনগুলোতেই দেখা যায়। ঈদ-পূজায় নিত্যনতুন ফ্যাশনের যে সূত্রপাত হয় সেটি থাকে সারা বছর। আমাদের পোশাকের সংস্কৃতিতে সেই বৈচিত্র্যই বিরাজ করে সারা বছর। কিন্তু পাশাপাশি দেশীয় কাপড়গুলোর ঐতিহ্য নষ্ট করার জন্য কিছু কিছু বিকৃত প্রতিযোগিতাও চলে। পাখি, আনারকলি, কিরণমালা বা গোপী নামের পোশাকে দেশ যেখানে সয়লাব সেখানে দেশীয়  ফ্যাশনের নতুনত্ব  কিছুটা মার খায়। তবে আধুনিক ফ্যাশন সচেতন হাল আমলের তরুণরা অবশ্য এদিকে খানিকটা হলেও সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। দেশে উল্লেখযোগ্য হারে ফ্যাশন ডিজাইনার ও ফ্যাশনকে পুঁথিগত পর্যায়ে নিয়ে আসাটাও একটি আশাব্যঞ্জক পরিচয়। দেশীয় ফ্যাশনের এই উৎকর্ষতাকে যদি ধরে রাখতে হয় তাহলে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে ক্রেতাদের। ফিউশন যেন সংস্কৃতির অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়।

(ছবি সৌজন্য: লুক)

রোকেয়ানামা ডেস্ক