সাবরিনা আকতার
অক্টোবর মাস হলো ‘ডাউন সিনড্রোম’ সচেতনতার মাস। এই লেখাটি ডাউন সিনড্রোমের ব্যাপারে জন সচেতনতা তৈরির জন্য লেখা। এ ধরনের শিশুর অনেক বাবা – মা শিশুর একেবারে ছোট বয়সে কিভাবে তাঁদের বিকাশের জন্য কাজ করবেন, কোথায় যাবেন বুঝতে পারেননা। আবার শিশুর গঠনগত সমস্যার সাথে অনেক সময় শিশুর অন্য কিছু সমস্যাও দেখা যায়। আশা করছি এই লেখাটি থেকে তারা ‘ডাউন সিনড্রোম’ সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবেন।
ডাউন সিনড্রোম একটা জন্মগত ত্রুটি এবং ক্রোমোজমাল ডিসঅর্ডার। ডাক্তার জন ল্যাংডন ডাউন ১৮৬৬ সালে এই সিনড্রোম বর্ণনা করেন বলে তার নাম অনুসারে এর নাম ‘ডাউন সিনড্রোম’ রাখা হয় ।
সাধারণত একজন ব্যক্তির ২৩ জোড়া অর্থাৎ ৪৬ টি ক্রোমোজম থাকে। কিন্তু ডাউন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ৪৭ টি ক্রোমোজম থাকে। ২১ নাম্বার জোড়ায় দুই এর অধিক ক্রোমোজম থাকলে বা সমস্যা থাকলে সেই ব্যাক্তিকে ‘ডাউন সিনড্রোম’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক ক্রোমোজম থাকার কারণে মস্তিষ্ক এবং শরীরের গঠন পরিবর্তন হয়ে যায়। ২১ নম্বর জোড়ায় সমস্যা হয় বলে একে ট্রিসমি 21ও বলা হয়ে থাকে।
ডাউন সিনড্রোম কেন হয়?
বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত ‘ডাউন সিনড্রোম’ কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারেন নি। তবে তাঁরা কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন –
* ৩৫ বছরের উর্ধ্বে যদি কেউ মা হতে যান তখন সেই বাচ্চার ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর রয়ে যায়।
* মা-বাবার কারো যদি ডাউন সিনড্রোম এ আক্রান্ত ভাই/ বোন থাকে।
* কারো একটা বাচ্চা ডাউন সিনড্রোম থাকলে তাদের পরবর্তী বাচ্চাটারও এতে আক্রান্ত হওয়ার চান্স খুব বেশি থাকে।
নিরাময়
ডাউন সিনড্রোম এর কোনো নিরাময় নেই। এটি প্রতিরোধও করা যায়না। বিজ্ঞানীরা জানেন না কেন ২১ নাম্বার ক্রোমোজমের সমস্যার কারণে এমন হয়? এটা মা-বাবার কোনো কোন পাপের ফল নয়। সমাজে এ ধরনের বিশেষ শিশুর বাবা-মা’কে এমন অনেক কথা শুনতে হয়। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই ভুল একটি ধারণা। এ বিষয়ে সমাজের মানুষকে সচেতন হতে হবে।
কিভাবে ডাউন সিনড্রোম নির্ণয় ( diagnosed ) করা যায়?
গর্ভাবস্থায় গর্ভের সন্তানের ডাউন সিনড্রোম আছে কিনা সেটা কিছু টেস্টের মাধ্যমে জানা যেতে পারে। এই টেস্টগুলো হলো –
১. স্ক্রীনিং টেস্টস
২. ডায়াগনোস্টিক টেস্টস
ডাউন সিনড্রোম শিশুর বৈশিষ্টসূচক লক্ষণ :
* খাটো বা ছোট মাথা।
* চওড়া বা সমতল পিঠ।
* ঘাড় শক্ত হওয়া, বসা , দাঁড়ানো এইসব অন্য স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় ধীর গতিতে হয়।
* অনেক সময় হিপ – ডিসলোকেশন থাকতে পারে।
* কখনো কখনো সমতল পা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি অন্যান্য আঙ্গুল থেকে দূরে সরে যেতে পারে।
* এক পলতা চামড়া চোখের পাতার ভিতরের কোনা ঢেকে রাখে।
* হাত, পা, ঘাড় , আঙ্গুল খাটো থাকে।
*কনুই , নিতম্ব এবং গোড়ালির জয়েন্টগুলো খুবই ঢিলে এবং শিথিল হতে পারে।
* ৫০% শিশুর ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রে সমস্যা থাকতে পারে।
* ওরাল মোটরে সমস্যা থাকতে পারে। বিশেষ করে জিভ একটু বড় থাকে।
ডাউন সিনড্রোম এর সাথে সম্পর্কিত কিছু অবস্থা ( related conditions )
* জন্মগত হৃদপিন্ডে সমস্যা
* চোখে সমস্যা
* কম শ্রবণশক্তি
* শ্বাসনালীর সমস্যা
* থাইরয়েড সমস্যা
* দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা
* স্থূলতা
* দৈহিক এবং মানসিক বিকাশ জনিত সমস্যা
* রক্ত জনিত সমস্যা
* অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিজনিত সমস্যা
* পরিপাকজনিত সমস্যা
* আলঝেইমার রোগ
* ডিমেনশিয়া
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ (Early intervention)
* জন্মের তিন বছরের মাঝে ফিজিওথেরাপি শুরু করলে শিশুর বিকাশের ঘাটতি এবং পেশির দুর্বলতা কমিয়ে আনা সম্ভব। তখন বসা, হামাগুড়ি দেয়া, দাঁড়ানো, হাঁটার দক্ষতা অর্জিত হয়। অঙ্গভঙ্গি এবং শরীরের ভারসাম্যের উন্নতি হয়ে শিশুকে স্বনির্ভর করতে সাহায্য করে।
* ফিজিওথেরাপির সাথে সাথে অকুপেশনাল থেরাপিরও প্রয়োজন হয়। এতে করে শিশুর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফাইন মোটর , গ্রস মোটর এর উন্নতি হয়।
* ডাউন সিনড্রোম শিশুদের ওরাল মোটরে সমস্যা থাকতে পারে। যার কারণে শিশুর মুখ দিয়ে লালা পড়ে। খাবার চিবিয়ে খেতে এবং গিলতে সমস্যা থাকে। কথা বলতেও সমস্যা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে স্পিচ থেরাপিস্টের পরামর্শ নিয়ে ওরাল মোটরের কিছু এক্সারসাইজ এবং ম্যাসাজ করতে হবে নিয়মিত। কথা বলানোর জন্য স্পিচ থেরাপি নিতে হবে।
ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত শিশু অন্যান্য সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর মতোই বেশির ভাগ জিনিস করতে পারে। কিন্তু সাধারণত তাদের বিকাশ একটু দেরিতে হয় অন্যান্য শিশুর তুলনায়। অনেকেই পড়ালেখা শিখতে পারে। কাজ করে স্বাধীনভাবে জীবনধারণ করতে পারে। জন্মের পরে অল্প বয়সেই আরলি ইন্টারভেনশন হিসেবে থেরাপিগুলো দেয়া শুরু করলে তাদের বিকশিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
প্রথম থেকেই কোয়ালিটি এডুকেশনাল প্রোগ্রামস , স্টিমুলেটিং হোম এনভায়রনমেন্ট এবং ভালো মেডিকেল কেয়ার পেলে ডাউন সিনড্রোম-এর ব্যক্তিবর্গ নিজ পরিবারের প্রতি এবং জাতীয় ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে সক্ষম। তাই অজ্ঞতা নয়, প্রয়োজন সচেতনতা । ডাউন সিনড্রোম শিশুর বাবা মায়েদের এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে , সেই সাথে পরিবারের সবাইকে শিশুর প্রতি সহযোগী মনোভাব বজায় রাখতে হবে। সর্বোপরি সমাজের মানুষকেও সহযোগিতার হাতা বাড়িয়ে দিতে হবে।
সাবরিনা আকতার, বিএসএড , এমএসএড ( রানিং, পাইজার, বিইউপি )/ প্রিন্সিপাল, কিডি রকস স্পেশাল নীডস স্কুল/ ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কিডি রকস লিঃ ।