নাহিদা খানম
দুজনের অসম বিয়ে মানেই মানুষের মুখরোচক আলোচনার খোরাক। আর সম্প্রতি ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিশা আর সেই স্কুলের এক সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিয়ের বিষয়টি যেন পৌঁছে গেছে অন্য এক মাত্রায়। তিশার বয়স ১৮, অন্যদিকে ৬০ পেরিয়ে গেছেন মুশতাক। আর কী লাগে? ফেসবুকে ঢুঁ দিতেই তাদের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে একের পর এক ভিডিও চোখের সামনে। বিচিত্র সব কনটেন্ট। কোথাও মুশতাক গান গাইছেন, তিশাও এমন সব কাণ্ড-কারখানা করছেন, যেন তারা ভিন গ্রহের কোন প্রাণী।
সামাজিক মাধ্যমের এই যুগে কোনো ইস্যু পেলেই মানুষ সেটাকে নিয়ে লেবু চিপে তিতা বানিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত থামে না। এক্ষেত্রেও তেমনটিই হয়েছে। আরেক অসম বিয়ে প্রিন্স মামুন ও লায়লাকে নিয়েও চলছে আলোচনা। তবে তিশা-মুশতাক নিয়ে মাতামাতি থামছেই না। বিষয়টি যে কেবল ফেসবুক কনটেন্টে সীমিত তা নয়। মূলধারার গণমাধ্যমগুলোও যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে এ নিয়ে কারা কত চটুল সংবাদ প্রচার করতে পারে। বেসরকারি কিছু টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে উপস্থাপনের বেলায় প্রশ্নগুলো শালীনতার সীমা অতিক্রম করে গেছে।
অন্যদিকে থেকে নেই এই অসম দম্পতিও। সদ্য ১৮তে পা রাখা তিশার কাছে দুনিয়া এখনো রঙিন। কিন্তু শত ঘাত-প্রতিঘাত পার করা মুশতাকের কাছে তো তা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি টিনএজার প্রেমিকের মতো নিজের কন্যার চেয়েও কম বয়সের স্ত্রীকে নিয়ে ছবি, ভিডিওতে সয়লাব করে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। লিখেছেন বই আর বইমেলায় তা প্রকাশও হয়েছে। সেখানে ঘটেছে আরেক কাণ্ড। একদল তরুণ নৈতিক পুলিশিংয়ের ভূমিকা নিয়ে এই দম্পতিকে মেলা ছাড়তে বাধ্য করেছে। তাদের দাবি, তিশার সঙ্গে প্রেম নিয়ে মুশতাকের বই বের করার অধিকার ছিল না।
কিন্তু এই বিয়ে নিয়ে সমাজ গেলো বলে যে হইচই পড়ে গেছে তা কতটা যৌক্তিক? সমাজের চোখে নৈতিকতা এক বিষয়, আর আইনগত বৈধতা আলাদা বিষয়। নৈতিকতা সময়ে সময়ে পাল্টায়, আবার একজনের চোখে যা নৈতিক, আরেকজনের চোখে তা অনুচিত। আর তা লিখিত কোনো বিষয়ও নয়। কিন্তু আইনে সব কিছু লিখিত। কী করা যাবে, কী যাবে না, তা সুনির্দিষ্ট। সেখানে একজনের চোখে বৈধ আর আরেকজনের চোখে অবৈধ- এই ভেদাভেদের কোনো সুযোগ নেই।
অসম বিয়ের আলোচনায় মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন ১৯৬১ যেমন আসবে, তেমনি আসবে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। সেটি করলে বর বা তার পরিবার এবং মেয়ের পরিবারেরও শাস্তি হবে।
প্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তার অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ড হতে পারে। যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বিয়ে করেন তবে তার অনধিক ১ মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০ হাজার হাজার টাকা জরিমানা বা দুই ধরনের সাজাই হতে পারে। সাজা হবে তাদের বাবা- মা এবং বিয়ের সঙ্গে জড়িতদেরও। তাদের সাজা হতে পারে দুই বছরের, জরিমানা ৫০ হাজার টাকা।
তিশার বয়স কিন্তু ১৮। তার বাবা মুশতাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার পর তার প্রমাণ আদালতেই হয়েছে। মুসলিম বিবাহ আইন ও তালাক (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪ এবং ২০১১ সালে করা বিধিমালা অনুযায়ীও তাদের বিয়েকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। এই আইন ও বিধিমালায় বলা আছে, সমাজের রীতিনীতি যাই হোক না কেন, ধর্মীয় আচার বিধি পালনের পরেও প্রতিটি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধিত হতে হবে। আর নিবন্ধন করা সব বিয়েই বৈধ।
আইনে তিন ধরনের বিয়ের কথা বলা আছে-
প্রথমত বৈধ বিয়ে: বিয়ের প্রয়োজনীয় শর্তগুলো হলো একপক্ষ থেকে প্রস্তাব, অপর পক্ষের সম্মতি, পর্যাপ্ত সাক্ষী, নির্দিষ্ট বয়স, দেনমোহর, দুই পক্ষের মধ্যে কোন আইনি অক্ষমতা না থাকা বা নিষিদ্ধ সম্পর্ক যেমন, একজন মুসলিম ও অন্যজন অমুসলিম না হওয়া। এরকম বৈধ বিয়ে হলে সন্তানরা বৈধ হবে, দেনমোহরের অধিকার পাবে, ভরণপোষণ পাবে, উত্তরাধিকারী হবে।
দ্বিতীয়ত অবৈধ বিয়ে: যে বিয়েতে প্রয়োজনীয় শর্ত পালন হয় না, আইনের দৃষ্টিতে তা অবৈধ বিয়ে। দুই পক্ষের মধ্যে নিষিদ্ধ সম্পর্ক থাকলে, যেমন: একজন মুসলিম নারীর সঙ্গে অমুসলিম পুরুষের বিয়ে হলে, একজনের স্ত্রী আছে জানার পরেও তাকে বিয়ে করলে বা জোর করে বিয়ে করলে তা বিয়ে সংক্রান্ত কোনো অধিকার সৃষ্টি করে না। এক্ষেত্রে তাদের সন্তানরাও স্বীকৃত হবে না, উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাবে না, এখানে দেনমোহরের অধিকারও থাকবেনা।
তৃতীয়ত অনিয়মিত বিয়ে: এটি এমন এক ধরনের আয়োজন, যেখানে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পালন হয় না, কিন্তু পরে পালনের সুযোগ থাকে। যেমন সাক্ষী ছাড়া বিয়ে করা, চারটি স্ত্রী থাকার পরও আরেকটি বিয়ে করা, ইদ্দত চলাকালীন সময়ে বিয়ে করা, ধর্মের কারণে নিষিদ্ধ হলে বা নিষিদ্ধ সম্পর্কের কারণে। অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে সন্তানরা বৈধ এবং উত্তরাধিকারী হবে, কিন্তু স্বামী ও স্ত্রীর ক্ষেত্রে একে-অপরের উত্তরাধিকারী হবে না। দেনমোহর ও বিবাহ ভঙ্গের ক্ষেত্রেও রয়েছে তারতম্য।
এসব বিবেচনাতেও তিশা-মুশতাকের বিয়েকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। কারণ, মুশতাক তিশাকে প্রস্তাব দিয়েছেন, তিশা সম্মতি দিয়েছেন, তাদের সম্পর্ক অবৈধ নয়, দুজনই মুসলিম, সেই বিয়ের সাক্ষীও আছে। তিশা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছেন। আর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার আইনি অধিকারও হয়েছে। কাজেই বিষয়টি সেখানেই থেমে যাওয়াই উচিত ছিল।
কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের এই যুগে ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ নামে এক শ্রেণির মানুষের আবির্ভাব হচ্ছে, যেখানে যত ভিউ তত টাকা। এই বিষয়টিই এই আলোচনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কনটেন্ট বানিয়ে ভিউ বাড়িয়ে পয়সা বানানোর ইচ্ছা তিশা-মুশতাকেরও আছে কি না কে জানে?
বয়সের দিক দিয়ে অসম বিয়ে কিন্তু এর আগেও হয়েছে। কিন্তু তারা মুশতাক-তিশার মতো প্রকাশ্যে এসে নিজেদের এমন প্রচারের ব্যবস্থা করেননি। গণমাধ্যম এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাদের পেছনে ভিউয়ের নেশায় দৌড়ায়নি। এই বিয়েকে যদি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ধরে কনটেন্ট তৈরি বা গণমাধ্যমের অনুষ্ঠান তৈরি করা হয় তাহলে যারা এগুলো তৈরি করছেন, তাদের নৈতিকতার বিষয়টিও সামনে আসে। একই বিষয় বারবার প্রচার করে সমাজে আসলে কী উদাহরণ তৈরি করছেন তারা?
আর এমন অসম বিয়ের খবর যে পত্র-পত্রিকায় আসে না তাও কিন্তু নয়। ২৫ বছর বয়সী তরুণীর সঙ্গে ৮০ বা ৮৫ বছ বয়সী পুরুষের বিয়ের খবরও তো আসে যা পরিবারের সম্মতিতে অনেক সময় কনের অসম্মতি থাকার পরও বিয়ে হয়। কিন্তু একদিনের সংবাদ বাসী হওয়ার পর তা নিয়ে আর পরে মাতামাতি তো দেখিনি আমরা। সমস্যাটা তখনি হয় যখন অসম বয়সী দুজন মানুষ নিজ ইচ্ছায় বিয়েটা করেন। তবে এখানেও সবার থামাটা জরুরি।
লেখক: নাহিদা খানম (আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট)
( প্রিয় পাঠক, আইনি অধিকার সম্পর্কিত কিছু জানার থাকলে আপনার প্রশ্ন পাঠাতে পারেন রোকেয়ানামার ই-মেইল এড্রেস এ। রোকেয়ানামার ‘উকিল আপা’ সেকশনে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন বিশেষজ্ঞরা। ই-মেইল এড্রেস- rokeyanama@gmail.com)