মিম্ মি রহমান
‘আপনার সন্তানকে অভাব শেখান’ শিরোনামের একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল বছরখানেক আগে। গতকাল আবারো চোখে পড়লো পোস্টটি। দু:খিত, আমি এই পোস্টের সাথে ১০০ ভাগ দ্বিমত পোষণ করছি, মূল পোস্টদাতার মতামতকে সম্মান জানিয়েই।
প্রত্যেকের জীবনবোধ, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী, জীবন-যাপনের পদ্ধতি, লালনপালন, পারিবারিক পরিবেশ, ধর্মীয় বিশ্বাস, বন্ধুমহল তো এক নয়। তাই থ্রট প্রসেসও এক হবে না সেটাই স্বাভাবিক।
পৃথিবীতে সবার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান সমান নয়। এই অবস্থানগুলো বহু কষ্ট করে, রক্ত, ঘাম, স্বপ্ন মিলিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। অসৎ উপায়ে যারা অর্থ উপার্জন করেন তাদের কথা বাদ রাখছি এখানে। তাই আমার মনে হয় বাবা-মা নিজের সন্তানদের তাদের পারিবারিক সামর্থ্য অনুযায়ী জীবন চালানোর শিক্ষা দেয়া উচিত। অভাবে কিংবা সামর্থ্যের বাইরের বিলাসী জীবন যাপনের শিক্ষা নয়।
তো এখন কথা হচ্ছে, বাবা-মা সন্তানকে অভাব শেখাবেন কেন? বাচ্চা কি স্বেচ্ছায় এসেছে পৃথিবী নামক পরীক্ষাকেন্দ্রে ? না। সে নিজের ইচ্ছায় আসেনি। মা-বাবা স্বেচ্ছায় পরিকল্পনা করেই তাদের পৃথিবীতে এনেছেন। অথবা আমার রোগীদের ভাষায় যদি বলি “আমি কিচ্ছু জানি না ম্যাডাম এমনে এমনিই হইয়া গেছে।” হ্যাঁ, এভাবেই বাচ্চারা দুনিয়ায় চলে আসে। সুতরাং একটা মানুষকে সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক এবং নিরাপদ জীবন যদি একটা বয়স পর্যন্ত আপনি দিতেই না পারেন প্লিজ সন্তান জন্ম দিবেন না। কিন্তু জন্মের পর সন্তানকে নিয়ে “এসো অভাব শিখি”র স্কুল খুলবেন না। আপনার জীবনে ,পরিবারে অভাব থাকলে সন্তান জন্ম দিবেন না। অযথাই একটা মানব শিশুকে পৃথিবীতে এনেই যুদ্ধে নামিয়ে দিবেন না। নিজে নিজের জীবন নিয়ে যুদ্ধ করুন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য হওয়ার পরেই বিয়ে করুন, সন্তান আনুন।
একটা পাঁচ-দশ বছরের শিশুর মন যা চায় পনেরোর কিশোরের মন কিন্তু তা চায় না। আবার আঠারোতে চাহিদা বদলে যায়। সন্তান এখন না হয় ছোট এক সময়ে যখন সে বড় হবে তখন ঠিকই বুঝবে সামর্থ্য থাকার পরেও মা-বাবা তাকে অভাব শিখিয়েছে। তার আত্মাকে কষ্ট দিয়েছে। তখন এই শেখানো বিদ্যাটা যদি সে বৃদ্ধ মা-বাবার উপরে এপ্লাই করে তখন মা-বাবার কেমন লাগবে? ঐ যে শেখানো অভাব মনোবৃত্তি যদি বৃদ্ধ মা-বাবার অসুস্থতার সময়ে সামর্থ্য থাকার পরেও হাসপাতালের কেবিনে না রেখে ফ্লোরে ফেলে রাখে ভালো লাগবে কি তখন? এ ধরনের ঘটনার রোজকার সাক্ষী আমার মত অসংখ্য ডাক্তারের পাপী চোখ।
বাবা-মার সামর্থ্য থাকলে সন্তানের প্রাসঙ্গিক চাহিদা পূরণ করতে সমস্যা কোথায়? তাই বলে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা বাইক চাইলো আর মা-বাবা সেটা কিনে দিলেন সামর্থ্য আছে বলেই, ব্যাপারটা কখনোই তা নয় কিন্তু। সন্তানের চাহিদা যেন বয়স অনুযায়ী হয় সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
সন্তানের প্রাসঙ্গিক চাহিদা বাবা-মার সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই পূরণ করা উচিত। সামর্থ্য না থাকলে সেটা সন্তানকে বোঝানো উচিত। বরং সন্তানকে মিতব্যয়ী/হিসেবী হতে শেখান। অভাব না। দুটো শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ ধারন করে।
সামর্থ্য থাকার পরেও আরোপিতভাবে অভাব শেখানো আমার মতে একটা ভুল প্যারেন্টিং। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই অভাবী হয়ে থাকেন তাহলে একজন মানব শিশুকে পৃথিবীতে আনার আগে নিজের অভাব দূর করার জন্য হোমওয়ার্ক করুন। অর্থনৈতিক সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করুন। তারপর সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিন। আর এসব বাকওয়াস “এসো সন্তান তোমাকে অভাব শিখাই” মাথা থেকে তাড়ান।
লেখক: মিম্ মি রহমান, চিকিৎসক ও লেখক
ছবির মডেল: রায়াত রহমান সাদা ও রাহিক রহমান সহজ