রুমা খোন্দকার
মানসিক রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়গুলো বুঝতে গেলে শারীরিকভাবে ও সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষের ভিন্নতার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাধারণত দেখা যায় একজন মানুষের বংশগত এবং সমাজে তার যে অবস্থান বা অভিজ্ঞতা কেমন, তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। ভিন্ন লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম হয়ে থাকে। গবেষণায় পাওয়া যায়, মানসিক রোগ তৈরিতে নারী ও পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য বিদ্যমান। বিশেষ করে বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, না খাওয়ার রোগ, এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বেশি লক্ষ করা যায় নারীদের মধ্যে।
বিষন্নতা
নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই মানসিক রোগটি লক্ষ করা যায়। দেখা যায় একই ধরনের বংশগত বৈশিষ্ট্য, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সাফল্যের পরও পুরুষের তুলনায় নারীরা এ ধরনের মানসিক রোগে দ্বিগুণ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। আর যাদের মধ্যে জটিল আকারে বিষন্নতা রোগ রয়েছে সারাবিশ্বে তাদের বেশ বড় একটি সংখ্যার মাঝে প্রতিবন্ধিতা তৈরি হয়। প্রতিবন্ধী নারীদের মধ্যে ৪০ ভাগ প্রতিবন্ধিতা তৈরি হয় বিষন্নতা রোগের কারনে আর পুরুষের ক্ষেত্রে এর হার ৩০ ভাগ।
উদ্বিগ্নতা
এটি আরেকটি মানসিক রোগ যা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়। এক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। টেস্টোস্টেরন নামক এক ধরনের হরমোন যা পুরুষের বেশি থাকে। আর এর ফলে এই সুবিধাটি বেশি পায় তারা যা তাদের উদ্বিগ্নতা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাই উদ্বিগ্নতা রোগে যারা চিকিৎসার সাহায্যে আসেন তাদের বেশিরভাগই নারী এবং তাদের মধ্যেই বেশি শনাক্ত হয়ে থাকে।
ট্রমা বা মানসিক আঘাত
যেসব ব্যক্তি জীবনে কোন না কোন সময় ক্রাইসিস মুহূর্তে উপস্থিত থাকেন যেমন: যুদ্ধ, বিগ্রহ, শরনার্থী, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগের শিকার বা দূর্ঘটনা বা সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। ২০ ভাগ নারী জীবনে কোন না কোন সময় ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। যা তাদের মধ্যে ট্রমা তৈরি করে। নারীদের মধ্যে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা বেশি থাকার কারনে মানসিক আঘাতজনিত রোগ তাদের বেশি হয়।এ ধরনের মানসিক রোগে পুরুষের তুলনায় নারীরা দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে কখনও তীব্র মাত্রার লক্ষণও বেশি প্রকাশ পায় যা উদ্বেগজনক।
আহারজনিত মানসিক রোগ
মেয়েরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। খাওয়া,শরীরের ওজন এবং কেমন দেখাচ্ছে এই চিন্তাধারার মাঝে এক ধরনের বাতিকগ্রস্ততা তৈরি হয় তাদের মাঝে।এ কারনে তারা আহারজনিত মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে বেশি। এর সাথে বিষন্নতা ও উদ্বিগ্নতাও থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলে যাওয়া ৬ ভাগ কিশোরী তাদের ওজন কমিয়ে রাখতে না খেয়ে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে একসময় খাদ্যজনিত অসুখ সৃষ্টি হয়।তারা বমি করে, ক্ষুধামন্দার ওষুধ খায় যা ঝুঁকিপূর্ণ। এই কারনগুলো ছাড়াও কম আত্মবিশ্বাস সম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের মেয়েদেরও এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
আত্মহত্যা
নারীরা বেশিরভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে যদিও পুরুষরা বেশি মারা যায়। এমনকি প্রথমবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া নারীরাই পরবর্তীতে আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে,একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেই সে বেঁচে গেল এমনটি ভাবনা অমূলক বরং তার ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।
সামাজিক চাপ
সমাজের দৃষ্টিতে যেসব নারীরা বুদ্ধিমতি, কোমলমতি, দেখতে সুন্দর তারাই সমাজে বেশি মূল্য পায়। আর পুরুষদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত,সৎ, অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল, নেতৃত্ব বৈশিষ্ট্য যাদের থাকে তাদের বেশি মুল্য দেয় সমাজ। এই জন্য যাদের মধ্যে এসব গুণাবলী কম তাদের আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে কমতে থাকে সামাজিক চাপে এবং মানসিক রোগে অক্রান্ত হয় বেশি।
স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরুষের তুলনায় নারীদের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায়। আমাদের দেশেও পরিবারে একজন নারী পুরুষের তুলনায় চিকিৎসা সেবা কম পেয়ে থাকেন। ফলে নারীদের অযত্ন ও অবহেলার শিকার হতে হয় যা ঝুঁকিপূর্ণ।
নেশাগ্রস্ততা
একজন নেশাগ্রস্ত পুরুষের তুলনায় একজন নেশাগ্রস্ত নারীর ক্ষেত্রে বেশি মাত্রায় নেতিবাচক লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর সাথে সন্তান লালন পালন ও সংসার দেখভালের দায়িত্ব থাকায় নারীদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায় বেশি।
কোভিড ১৯
প্যানডেমিকের এই অবস্থায় পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি একাকীত্ব, উদ্বিগ্নতায় ভুগতে হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া, বাড়িতে অফিসের কাজ করা, শিশুর যত্ন নেয়া, সংসার সামলানো,অর্থনৈতিক চাপ নারীকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
জাতিগত ভিন্নতা
ভিন্ন জাতিগোষ্ঠির উপর কোন সহিংস ঘটনা ঘটলেই তার শিকার সবচেয়ে বেশি হতে হয় নারীদের যা সবসময় তাদের মানসিকভাবে আতংকগ্রস্ত করে রাখে।
শুধু নারী হওয়ার কারন
শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারনেই নারীদের সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকা, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়া, সম্পত্তির অধিকার ভোগ করতে না পারা, শারীরিক আগ্রাসনের শিকার হওয়া, নিরাপত্তার দুশ্চিন্তা তাকে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
তাই একজন নারীর নিজেকেই তার মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এছাড়াও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর রাখা ও সচেতনতা তৈরি করা সমাজের সকলের দায়িত্বের মধ্যেই চলে আসে।
রুমা খোন্দকার, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট
Superb and crystal clear. Please keep it up. However, seems reference missing.
Thank you for your feedback! About reference, I will not miss next time 🙂