মোসাম্মাৎ নাজমা খাতুন
“আমি ওকে কেবল আবার একটা ফোন দিতে চাই। যদিও আমি জানি এটা ঠিক হবেনা। ও কেবলই আমার সঙ্গে চিৎকার ও দুর্ব্যবহার করবে আমি জানি। এটা ভেবেই আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি বাইরে কাজকর্ম করতে পারছি না। একেবারেই মনোযোগ দিতে পারছি না। আমি চিৎকার করে সবাইকে বলে দিতে চাই যে আমি ভাল নেই। আমি তাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। দিনে দিনে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছি।” এটা সম্প্রতি বিয়ে ভেঙে যাওয়া একজনের আত্মচিৎকার।” তিনি ভাবছিলেন সম্পর্কটি পুন:উদ্ধার করা যায় কিনা। স্বামী ও সন্তান দূরে থাকার ভয়ে তিনি ভীত। হতাশা আর অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। কাজকর্মে আগের মতো নিজেকে সক্রিয় রাখতে পারছেন না।
কোন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার পর এমন প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরুষ বা নারী যে কারও জন্যই বিয়ে ভেঙে যাওয়া এক তীব্র সামাজিক ও মানসিক বিপর্যয় হিসেবে কাজ করে। বৈবাহিক সম্পর্ক আমাদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিয়ের মাধ্যমে দুটি মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক তা সামাজিক ও আইনগত স্বীকৃতি পায়। এ সম্পর্ক কেবল দুজন মানুষের মধ্যে নয়, দুটো পরিবারের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে। তাই বিয়েকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে আমাদের সকল ধর্ম ও সংস্কৃতিতে নানা ধরনের রীতিনীতির সমাহার সামাজিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশেও বিয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্ক বিষয়টিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বৈবাহিক সম্পর্কে সুখী হওয়া বা না হওয়া নানা বিষয়ের উপর নির্ভর করে। আবার বিবাহিত জীবনের নানা পর্বের সাথে খাপ খাওয়ানোও একটা কঠিন বিষয়। অবাস্তব প্রত্যাশা, দায়িত্বহীনতা আবার স্বামী বা স্ত্রীর কাজের মাত্রা ও ধরন। শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে মানিয়ে চলা, যোগাযোগ দক্ষতার অভাব, আর্থিক সমস্যা, সেক্স সংক্রান্ত সমস্যা ও অবিশ্বস্ততা বৈবাহিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে ভূমিকা রাখে।
সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটার ক্ষেত্রে একক কোন কারণ নেই। এটি শুরু হয় নানা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। কখন ও কখনও একজন সঙ্গী আরেকজনকে আলাদা থাকার হুমকি দিয়ে আবেগীয় প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নিতে চায়। ‘এই সংসারে আমি আর পারছিনা, আমি চলে যাব’ এই জাতীয় কথাবার্তা মূলত যিনি চলে যেতে চান তার মুখ থেকেই বেশি শোনা যায়। বিচ্ছেদের সম্পর্ক আরও একধাপ এগিয়ে যায় যখন কোন সঙ্গী বলে উঠেন, ‘আমি কালই উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দিব। আমি তোমার কাবিনের টাকা যোগাড় করে ফেলেছি, তুমি চলে যেতে পার’ ইত্যাদি। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা ভালোবাসা ও ঘৃণা দুটো বিষয়কে একই অনুষঙ্গ হিসেবে দেখেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ‘আমি মরতে চাই’ যেমন বাঁচার আকুতি বহন করে তেমনি ‘আমি ডিভোর্স চাই’ এটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আবেদন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেষ পেরেকটি টুকে দেয়া হয় যখন কোন সঙ্গী অন্য কারও আবেগীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কিংবা নির্যাতনের মাত্রা জীবননাশের হুমকী হয়ে দাঁড়ায়।
সম্পর্কে বিচ্ছেদ সবসময় বেদনাদায়ক নাও হতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে বিচ্ছেদে কোন ব্যক্তি যন্ত্রণা থেকে মুক্তিও পেতে পারে।দুটি সত্য ঘটনা তুলে ধরা যাক-
ঘটনা – ১
ষাট বছরের রীতা (ছদ্ম নাম) সারাজীবন স্বামীর অত্যাচার, যন্ত্রণা সহ্য করে একটু ধাতস্থ হতে চেষ্টা করছিলেন।ভাইদের সহযোগিতায় দুই ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন। তারা দুজনই বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। রীতাও ছেলেমেয়েদের সাথে দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন।স্বামী রীতার অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। অর্থনৈতিক বিচারে স্বামীও সমাজের উঁচু স্তরের লোক। গা সয়ে যাওয়া রীতা ছেলেমেয়েদের সময় দিতে গিয়ে স্বামীর কথা ভুলতেই বসেছিলেন বলা যায়। দেশে আসার কিছুদিন পর জানতে পারলেন, তার নামে কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, স্বামীর অধিকার নিয়ে রীতার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িতে থাকার জোর দাবি তুলছেন। রীতা এবার আর সহ্য করলেন না, কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েই নিলেন। ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে পাড়ি জমালেন বিদেশে । এ যেন দীর্ঘ দিন বয়ে বেড়ানো একটি অসুস্থ সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিয়ে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলা।
ঘটনা- ২
বত্রিশ বছরের আরশির ( ছদ্ম নাম) বিয়ের বয়স পাঁচ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ পরিচয় থেকে পরিণয়। শেষমেশ দুই পরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে ছিল মনে রাখার মতো। আস্থা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ স্বামী আর্য্য ছিল তার কাছে অনেকটা দেবতার মতো। আরশি চাকরি করত বিমানের ফ্লাইং অফিসার হিসেবে। ফ্লাইটের সঙ্গে জীবনের সূচি মেলাতে গিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন আরশি। আর্য্যর সহায়তায় আবারও কাজে মন দেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই আরশির মনে হতে থাকে সংসারে মনোযোগ দিতে না পেরে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলছেন। সংসারটা তার কাছে বড় ভালোবাসার জায়গা। এক জীবনে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকার বিকল্প আর কি-ই-বা হতে পারে! এবার চাকরিই ছেড়ে দিলেন আরশি।ইতিমধ্যে মা হয়েছেন তিনি। স্বর্গসুখ যেন তার হাতের মুঠোয়। নিজের ছোট শিশুর দেখভাল করার জন্য নিয়ে আসেন তারই খালাতো বোনকে। আর্য্যও খুব খুশি হয়েছে আরশির কষ্ট কমবে বলে। স্বামীর ঘুম নষ্ট হবে বলে আরশি প্রায়ই ছোট শিশুকে নিয়ে অন্য ঘরে ঘুমাতেন। সময়ের পরিক্রমায় আরশি আর্য্যকে আবিষ্কার করে তারই খালাতো বোনের সাথে আপত্তিকর অবস্থায়। এই মানসিক আঘাত তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারেন নি। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজেই স্বাক্ষর করেন ডিভোর্সের দলিলপত্রে।
ডিভোর্স পরবর্তী মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য দুটি উদাহারণই যথেষ্ট মনে হয়। যিনি ডিভোর্স নিতে উদ্যোগী হন তার জন্য সাময়িক চাপ লাঘবের কাজ করতে পারে। তবে বেশিরভাগ দম্পত্তির ক্ষেত্রে ডিভোর্স তীব্র মানসিক ক্ষত তৈরি করে থাকে। সম্পর্কে বিচ্ছেদের আঘাত পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে। আমরা যদি আরশির দিকে তাকাই, সম্মানজনক পেশা ছেড়ে দেয়া, চুরমার হয়ে যাওয়া স্বপ্নময় সংসার, এ যেন এক অসহনীয় রূপকথা। ক্ষিপ্রতার সাথে আরশি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাস্তবিক অর্থে যে সম্পর্কটি আর নেই আরশি যেন সেটি আর আত্মস্থ করতে পারছিলেন না। তার জীবনেই এমন ঘটল? কি দোষ ছিল তার? না কিছুতেই আরশি মেলাতে পারছিলেন না তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।মাঝে মাঝে ভাবেন, এমন কিছু যদি ঘটতো যাতে সব পাল্টে গিয়ে আগের মতো হয়ে যেতো। সময় ঘড়িটাকে পিছিয়ে দেয়া যেত!
মাঝে মাঝে এও ভাবেন, আচ্ছা কম্পিউটারে কিছু লিখে যেমন ডিলিট করে ফেলা যায়,আর্য্যর ওই চ্যাপ্টারটাও এরকম ডিলিট করে দিলেই তো হতো। পুরোটাই তো ভাল ছিল। আমারও তো কিছু দায় ছিল, কেন আমি আলাদা ঘরে ঘুমোতে গেলাম। এ জাতীয় নানা না -জানা উত্তর ভিড় জমায় আরশির মনে। এরকম আকম্মিক অপ্রত্যাশিত মানসিক চাপকে বলা হয় ‘তীব্র মানসিক আঘাত’। তীব্র মাত্রার শারীরিক ক্ষত সারতে যেমন দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় তেমনি মানসিক আঘাত থেকে সেরে উঠতেও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতার। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে শারীরিক ও মানসিক শক্তির ক্ষয় হয়। অবসাদগ্রস্ততা, হতাশা, জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা সবই খুব সাধারন প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে। সর্বোপরি ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমতে থাকে।
বিশেষ করে বৈবাহিক সম্পর্কে যিনি নির্ভরশীল থাকেন বা সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ থাকেন তার জন্য বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর চরম দুর্বিসহ হয়ে থাকে। আর্থিক টানাপড়েন, অতিমাত্রায় আবেগের নির্ভরশীলতা ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তা না পেলে ব্যক্তির এই মানসিকভাবে ভেঙে পড়া চলতেই থাকে। বিশেষ করে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের অবস্থা খুব অবজ্ঞার হয়ে থাকে। যেন তালাক প্রাপ্ত নারী সংসার করার অযোগ্য। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের মতো বিষয়ে তাকে বঞ্চিত করা হয়। বিচ্ছেদের পরে নারীদের আত্মপরিচিতি নড়বড়ে হয়ে যায়।
বেশিরভাগ মানুষ কারো স্বামী বা কারো স্ত্রী হিসেবে সমাজে আত্মপরিচয় ধারণ করে অভ্যস্ত।বিচ্ছেদ হবার পর এই আকস্মিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসই সমাজে তার স্বীকৃতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়।কেউ কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেন অন্য সকল যোগাযোগ থেকে। পরিচিত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সাথে তার দূরত্ব বাড়তেই থাকে।কিন্তু এটা না করে বরং এ বিষয়ে সচেতন থেকে পুরানো সম্পর্কগুলোকে ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে। সত্যিকারের বন্ধুর সহায়তা নি:সন্দেহে সহায়ক হবে।
অবশ্য কেউ যেন নি:সঙ্গতার সুযোগ নিয়ে ক্ষতি করতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এমন কাউকে বেছে নিতে হবে যার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি খোলামনে আলোচনা করা যায়। অনেকের মধ্যে বিচ্ছেদের দীর্ঘ সময় পরেও পূর্বের সঙ্গীর উপর তীব্র রাগ ক্ষোভ থেকে যায়। এটি ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে। অনেকে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু এটি ভুল। পূর্ববর্তী সম্পর্কের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা নতুন সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই একটি সম্পর্ক ভেঙে যাবার পর নিজেকে যথেষ্ট গুছিয়ে নেয়া দরকার, সময় নেয়া দরকার যাতে নতুন সম্পর্ক আরো বেশি পরিপূর্ণ হয়।
মোসাম্মাৎ নাজমা খাতুন (সহযোগী অধ্যাপক) ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়