0

কখন বুঝবো ‘বিয়ের জন্য তৈরি আমি’

Share

রুমা খোন্দকার

রক্তের সম্পর্কগুলোর পরেই বিয়ের মাধ্যমে যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা সবার আগে বিবেচিত হয়ে থাকে। ‘বিয়ে’ হচ্ছে সেই সামাজিক অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে একটি নারী ও পুরুষ সারাজীবন একসঙ্গে জীবন কাটানোর জন্য পারস্পরিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে থাকে। এ সম্পর্কের গভীরতা এবং দীর্ঘ পথ চলার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস, ভালোবাসা, কাছাকাছি থাকা-সর্বোপরি পারস্পরিক বোঝাপড়া। পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে এ বিষয়ে রীতিনীতিতে কিছু ভিন্নতা থাকলেও মূল উদ্দেশ্য প্রায় একইরকম। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, ভৌগলিক পরিমন্ডল যাই হোক না কেন, সমাজ গঠনে এবং তা সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য সেই আদিকাল থেকেই নারী ও পুরুষের এ সম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে।

বর্তমানে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিয়ের প্রচলিত ধারণাগুলোও পরিবর্তিত হচ্ছে। একসঙ্গে দু’জন নারী পুরুষকে থাকতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে কিছু পূর্বপ্রস্তুতির। নারী ও পুরুষকে সেই বাস্তব পরিস্থিতি ও প্রস্তুতির ব্যাপারে সচেতন হওয়াটা খুবই সময়োপযোগী হতে হবে। কেননা সমাজে বসবাসকারী মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সমঅধিকার, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, মনোভাব, চাহিদা, আকাঙ্খা-সহ মানবীয় বোধগুলোও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই বিয়ের আগে নিজেকে বারবার ভাবতে হবে এই মুহূর্তে আপনি বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা।

এই লেখার মাধ্যমে কিছু পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ করা হলো যার মাধ্যমে যাচাই করে নিতে পারেন আপনি বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা।

১) যাকে বিয়ে করার কথা ভাবছেন তার কাছে ‘বিয়ে’ বিষয়টি কি অর্থ বহন করে এবং সে এই সম্পর্ক থেকে কি কি প্রত্যাশা করে।

২) যাকে পার্টনার করার কথা ভাবছেন তিনি বর্তমানে  কি ধরনের জীবন ব্যবস্থায় আছেন এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কি চলতে পারবেন কিনা অথবা বর্তমান জীবনে আপনার যে চাহিদা গুলো রয়েছে তা পূরণের জন্য বিয়ের সম্পর্কের কাছে প্রত্যাশা করছেন কিনা -ভাবুন তো।

৩) পার্টনার  হিসেবে যে মানুষটিকে বা পরিবারটিকে আপনি ভাবছেন সেই মানুষটির কি আপনার যেসব প্রত্যাশা আছে তা সব সময় পূরণ করা সম্ভব?

৪)  ভাবুন তো অন্তত কি কি বৈশিষ্ট্য সেই মানুষটির মধ্যে থাকতেই হবে যাকে আপনি পার্টনার হিসেবে পেতে চান। এবার লক্ষ্য করুন আপনি নিজেও কি সেই বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে থাকেন, না কি আপনার নেই বলে তার কাছ থেকে আপনি তা পেতে চাইছেন।   

৫) যদি ভালবাসার সম্পর্কে থেকে থাকেন, তাহলে দু’জন কি কখনও নিজেদের ভালোলাগা, খারাপ লাগা, চাহিদা, সীমাবদ্ধতা এগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পেরেছেন? নিজেদের মধ্যে সেই শ্রদ্ধা, সম্মান, বিশ্বাসের জায়গাগুলো কি খুঁজে পাচ্ছেন, না কি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে? এছাড়া সম্পর্কটা কিভাবে তৈরি হয়েছিল দু’জন দ’জনকে জানা বোঝার মাধ্যমে না কি কোন কিছু না ভেবেই। তাহলে ভাবুনতো এই সম্পর্ক টিকে যাওয়ার সেই উপাদানগুলো কি কি। সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখুন।

৬)  আপনি কি নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, নিজের চাহিদাগুলো বুঝতে ও বলতে পারেন, নিজের অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানিয়ে চলতে পারেন? ঠিক একইভাবে আপনি কি অন্যের আবেগ, অনুভূতি, মতামত, সিদ্ধান্তের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন, মেনে নিতে পারেন কিনা।

৭)  আপনি নিজের এবং অন্যের মর্যাদাবোধ, শালীনতা, অধিকারবোধ এবং তার যথার্থতার মাত্রা বুঝে চলতে পারেন কিনা ভেবে দেখুন।

৮)  আপনি কি পুরুষ বিদ্বেষী কিনা আবার আপনি যাকে জীবনসঙ্গী করতে যাচ্ছেন তিনি নারীকে একজন সক্ষম মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে কিনা বা শ্রদ্ধাবোধ আছে কিনা ভেবে দেখুন। 

৯) আপনি একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কি না ভাবুন। কেননা বিয়ে হচ্ছে দু’জন মানুষের মধ্যকার আবেগীয় আদান প্রদান, যেখানে পারস্পরিক সমঝোতা ও ছাড় প্রদান অবশ্যই প্রয়োজনীয়। আপনি যদি আত্মকেন্দ্রিক হোন তাহলে তা কোন না কোনভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।

১০) ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোন গোপনীয়তা আছে কি যে বিষয়গুলো আপনাকে ভাবায় ? থাকলে বিয়ের আগেই জানিয়ে রাখুন। 

১১)  বিয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আপনার কি সে সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আছে কিনা এবং সে বিষয়ে পার্টনারের সাথে খোলামেলা আলোচনা বা মতামত প্রকাশে প্রস্তুত আছেন? আরো ভাবুন, কোন ধরণের দু:শ্চিন্তা এ বিষয়ে রয়েছে কিনা।

১২) এছাড়াও নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন ভূমিকা পালনে আপনাকে কি কি করতে হবে ভেবে রেখেছেন তো?

১৩)  কোন ধরনের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা বা অসুস্থতা থাকলে সেগুলো কি এবং  কিভাবে সেগুলো থেকে সুস্থ থাকা যায় বা সুস্থ থাকার জন্য কি কি ব্যবস্থা আপনি গ্রহণ করেছেন ভেবে দেখুন।

বিয়ের আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে আপনার কিছু দায়িত্ব

– চেষ্টা করুন ভিতরে বাইরে একরকম মানুষ হতে

– নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী হবু বর প্রত্যাশা করুন

– নিজের ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করুন

– পুরুষদের  ভূমিকার প্রশংসা করুন বা করতে শিখুন

– নিজস্বতা, নিজের সম্মানের বিষয়টিতে সচেতন থাকুন

– সুশৃঙ্খল যৌন জীবন সম্পর্কে জানুন

– ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জন করুন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ করুন

– নিজ উপায়ে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম থাকার চেষ্টা করুন, এতে নিজের আত্মসম্মানবোধ উন্নত হবে

পুরুষ হিসেবে আপনার সঙ্গীর নীচের বিষয়গুলো সম্পর্কে কতটা সচেতন যাচাই করে নিন

– নারীদের সম্পর্কে  দৃষ্টিভঙ্গী কেমন

– আপনার  ধ্যান ধারণার সঙ্গে তার মিল আছে কিনা খেয়াল করুন 

– একজন নারী তার সমান যোগ্যতার হতে পারে তা মানতে পারে কিনা যাচাই করুন

– নারীদেরকে কম শক্তি সম্পন্ন মনে না করে বরং তাদের অন্যান্য যোগ্যতার প্রশংসা করতে জানে কিনা

– ভালবাসার সম্পর্কে  বিশ্বাসী ও স্বচ্ছ কিনা

– আবেগের বশবর্তী হয়ে  বা পারিবারিক পছন্দকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আপনাকে সঙ্গী করছে কিনা জেনে নিন। 

বিয়ের মাধ্যমে সামাজিক সুস্থতা ধরে রাখতে চাইলে প্রয়োজন তা টিকিয়ে রাখা। টিকে থাকার মাধ্যমে একটি পারিবারিক আদল জন্ম দেয় আরেকটি সুস্থ প্রজন্ম, আর তাই সঠিক বর বা কনে বাছাই করাও প্রত্যেক্যের জন্য একটি অগ্রগণ্য সামাজিক দায়িত্ব। প্রয়োজনে বর বা কনে নির্বাচনের পূর্বে পেশাগত মনোবিজ্ঞানীর নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণ করুন। ভাবুন, যাচাই করুন, তারপর বিয়ের জন্য সিদ্ধান্ত নিন।  

রুমা খোন্দকার, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী

ছবি সৌজন্য-লুক

চিত্রশিল্পী- শাহজাহান আহমেদ বিকাশ