ডা. ছাবিকুন নাহার
সে চুল খায়, মাটি খায়, কবিতার মতো সুন্দর একটি মেয়ের কথা বলছিলাম। এ রোগ সম্বন্ধে যতটুকু জানি, তা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
রোগটির নাম পিকা। অদ্ভূত নাম। নামের চেয়ে অদ্ভূত তার কার্যকলাপ। এমন এমন sign/symptoms দেখে শুধু তাজ্জব বনে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
এ রোগে আক্রান্তরা এমন সব খাদ্য খান যাতে কোন ফুড ভ্যালু নেই। অর্থাৎ যে খাবার খেলে শারীরিক শক্তি পাওয়া যায় না বরং ক্ষতি হওয়ার আশংকা থাকে।
পিকা রোগীর পছন্দের খাদ্য সমূহ
– চুল, সবচেয়ে পছন্দের খাবার। এক গোছা করে টেনে তুলে এবং টুক করে গিলে ফেলে। কয়েকবছর আগে এমন এক রোগীর ইমার্জেন্সী অপারেশন করে কেজি খানেক চুল উদ্ধার করা হয়েছিল।
– মাটি, খাদ্য তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে। বিশেষ করে মাটির ব্যাংক,হাড়ি পাতিল। খুব যত্ন করে পার্স বা ব্যাগে লুকিয়ে রাখে। পরে ছোলা বুটের মতো কুট কুট করে খায়। কেউ কেউ জমির এঁটেল মাটি খায়। খুব নাকি সুগন্ধ, বাসমতি চালের মতো।
– ব্রাশ, আস্ত ব্রাশ কসরত করে গিলে ফেলে। এই গিলে ফেলতে পারাটাই নাকি চরম আনন্দের!
বেশ কিছুদিন আগে পেটে ভয়ংকর ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া এক রোগীর স্টোমাক থেকে ২৭ টা ব্রাশ, দুটো স্টিলের টি স্পুন বের করা হয়েছিল। সে অপারেশনের ছবি ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়েছিল। রোগীর স্ত্রীর রিএ্যাকশন ছিল এমন “এ জন্যই তো বলি, এত ব্রাশ আনি, কই যায়!!”
– সাবান। একসময় এক সাবান খেকো পিকা রোগীকে নিয়ে নিউজ হয়েছিল। উক্ত রোগী সমাজের বিত্তবানদের সাবান নিয়ে এগিয়ে আসতে বলেছিলেন। তার নাকি দৈনন্দিন ছয়টা করে সাবান লাগে!!
সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে পেলাম সেফটিপিন এবং তাদের ভাই বোন সুই, আলপিন, স্ট্যাপল পিন ইত্যাদি সব।
আরো কিছু খাদ্য বস্তু যা আমরা নিজেরাও কম বেশি ছোট বেলায় খেয়েছি। যেমন – মুরগীর বিষ্ঠা( চকলেট কালার, নিজের অভিজ্ঞতা), বোতাম, কয়েন, কাগজ। এগুলো সবচেয়ে হেলদি পিকা ফুড।
এখন আসি এরা কেন উক্ত বিচিত্র খাবার খায়? এই প্রশ্নের জবাবে বলছি :
এই ধরনের খাবারে রোগীর একধরনের ফেসিনেশন তৈরি হয়। যতক্ষণ না খেতে পারছেন ততক্ষণ এই ফেসিনেশন আনবিক বোমার রিএ্যাকশনের মতো চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। রোগী দিশাহীন হয়ে পড়েন। ইস্পিত খাদ্য পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন। অতপর গলাধকরণ করে শান্তি। আহ্!!
চিকিৎসা
সাধারণত এই রোগীদের সহজে ডায়াগনসিস করা যায় না। অন্যান্য মানুষের মতোই স্বাভাবিক। যদি না কোন সমস্যা হয়।
কমপ্লিকেশনস/জটিলতা
পেট ব্যাথা, বমি, ইনটেসটাইনাল অবস্ট্রাকশন ( নাড়ী ভুড়ির লুমেন বন্ধ হয়ে যাওয়া।), কনস্টিপেশন। অবস্ট্রাকশন হলে ইমার্জেন্সী অপারেশন করতে হয়।
মানসিক সমস্যা আছে কিনা সেটা সবার আগে দেখতে হবে। থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে।
সাইকোথেরাপি দিতে হয় অনেক সময়।
বিহেভিয়ার থেরাপি দিতে হবে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে সঠিক কাউন্সেলিং করতে হবে।
সর্বোপরি সহানুভূতিশীল সঠিক পারিবারিক সহায়তা এই ব্যাধি থেকে পিকা রোগীকে রক্ষা করতে পারে।
সর্বশেষ একটা গল্প বলে শেষ করছি
মধ্যরাত। উথালপাথাল পেটে ব্যথা। এক্সরে করে ধাতব কিছুর আভাস। রোগীকে ইমার্জেন্সী অপারেশন করা হলো। আতিপাতি করে খোঁজাখুঁজি চলছে। অবশেষে পাওয়া গেল তাহাকে। বিশাল এক সুই।
রোগীকে জিজ্ঞেস করা হলো,
– আপনি এটা খেলেন?
– সুইটা দেখে আমার এত ভালো লাগল! মনে হলো একে আমার খেতে হবে। না খেয়ে পারলাম না।
– আপনি আবার এমন খাবেন?
-রোগী উদাস কন্ঠে ফিলোসফারের মতো বললেন, ভবিষ্যতের কথা কি কেউ বলতে পারে?? খাইতেও পারি, পছন্দ বলে কথা…
ডা. ছাবিকুন নাহার, (এমবিবিএস, বিসিএস, এফসিপিএস) প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন (ঢাকা মেডিকেল কলেজ)