আইরিন ফাহিনূর সুলতানা
আমার মায়ের জীবনের গল্প নিয়ে আজ আমি চতুর্থ পর্ব লিখছি। অনিবার্য কারণবশত মাঝে কিছুদিনের বিরতি দিতে হয়েছে। আশা করছি আপনারা আমার মাকে ভুলে যান নি। আমি আগেও বলেছি আমার মায়ের জীবনের গল্পটা আমার কাছে অন্যরকম একটা আবেগের জায়গা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এটি আমার মায়ের জীবন কাহিনি হলেও আপনাদের প্রত্যেকের মায়ের জীবনেও রয়েছে এমন কিছু ঘটনা, তাই শুরু থেকে আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছি। আশা করি কিছুদিন বিরতি গেলেও আপনাদের কাছে আমার মায়ের জীবনের গল্পটা পড়তে খারাপ লাগবেনা।
সকালে নাস্তার টেবিলে পত্রিকার পাতায় চোখ না বুলালে বুঝি দিনটাই শুরু হতে চায়না। স্বামী স্ত্রীর মাঝে এই পত্রিকা নিয়ে লড়াইটা সেই শুরু থেকেই চলে আসছে। কে আগে পত্রিকায় লেখা খবরগুলো পড়ে নিজেকে সবজান্তা বিশেষণে বিশেষায়িত করবে, সেটা নিয়ে চলতো এক তুমুল প্রতিযোগিতা। অবশ্য শেষমেশ বিজয়ের মুকুট সেই আমার কপালেই এসে জুটত।
স্বামীর গোয়েন্দা বিভাগের চাকরির কারণে গোটা বিশ্বের খবরাখবর তার মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র পরিসরে ধরে রাখার অভ্যাসটা বুঝি আজও রয়ে গেছে। অন্যদিকে আমি হয়েছি ঠিক তার উল্টো। বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের রান্নার খবরই হোক আবার নানা রকম উৎকট রোগের কাহিনী হোক, মাথায় রাখা এ সব বোঝাকে তুলে নিই শত পৃষ্ঠার ডায়রিতে। ডায়েরির পাতায় পাতায় পত্রিকার টুকরোগুলো সাজিয়ে রাখি নিজের মতোন করে। যখনই কোন আলাপের প্রসঙ্গে সংগৃহীত তথ্যের মিল খুঁজে পাই, ব্যাস হয়ে গেলো আমার সব তথ্যের ভাণ্ডার নিয়ে তর্কের যুক্তি খণ্ডনের জন্য। সেই কত ডায়রি যে জমিয়েছি এই জীবনে তা এখনও অগুণতি রয়েছে হিসেবের খাতায়।

আমার এই স্বভাবের প্রতিফলন ঘটেছে আমার ছেলের স্কুল জীবনেই। মায়ের হাত ধরেই বিতর্কের তালিকায় শ্রেষ্ঠ বক্তা হবার সৌভাগ্য জুটে তারই কপালে। কে বলেছে ছেলেরা শুধু বাবার আদর্শে বেড়ে ওঠে। সন্তানরা যে চুপি চুপি মায়ের ছায়া ঘেরা আঁচলেই জীবনের ঠাই খুঁজে পায় সেটা কারো চোখে পড়ে না বুঝি!
একদিন ভুলবশত পত্রিকার প্রয়োজনীয় কলামগুলো আগেই কেটে একাকার করে ফেলি। বাড়ির অন্যরা সেই পত্রিকা পড়তে চাইবে কিনা তা আর বুঝে উঠতে পারিনি। হঠাৎ আমার ছোট মেয়েটি এসে বলল ওর বাবা নাকি আজকের পত্রিকাটি দিতে বলেছে। গরম আয়রনের উত্তাপে যেমন কাপড় পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, আমার কলামের কাটাকুটিতে পত্রিকাটির সেই একি দশা হয়েছিল। পত্রিকাটি হাতে নেওয়া মাত্রই কঠিন বজ্রপাতের বেগে ও আমার দিকে ছুটে আসলো। মেশিনগানের বুলেটের মতো কথার পৃষ্ঠে কথা বলে আমাকে কিছু উপদেশ বাণী দিয়ে আবার চলে গেলো। বুক ধড়ফড়ের মাঝে ওকে আমার কলাম সাজানো সেই ডায়রিটাই আর দেখানো হলো না তখন।

হাতের কাছে রিমোটটি দেখতে পেয়ে বসে পড়লাম টেলিভিশনের পর্দায় খবর দেখব বলে। যদিও ইদানিং চ্যানেলগুলোতে দুর্ঘটনার খবর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না আমার। চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টালেও সেই একই ঘটনা বারবার পর্দায় ভেসে আসে। পত্রিকার সাথে টেলিভিশনের এই পার্থক্য। পত্রিকায় কোন দুর্ঘটনার খবর পড়তে না চাইলে শুধু পাতা উল্টালেই কাজ হয়ে যায়। কোন খবরটা দিয়ে পড়া শুরু করবো আর কোনটা পড়ে শেষ করবো সেটা সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তেই থাকে। অন্যদিকে টেলিভিশনের পর্দায় সেই পাতা উল্টানোর কোনও সুযোগ থাকেনা। খবরের একটি অংশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরের খবরে যাওয়ার আর কোনও উপায় নেই। তাই সম্পূর্ণ খবর দেখতে বসলে একটা না একটা দুর্ঘটনার চিত্র চোখে পড়বেই।
দুর্ঘটনার সাথে আবার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে আমার। ভাইরাসের মতো একবার ছোঁয়া লাগলে আর পিছু ছাড়ে না সহজে। রেল লাইনের ঘটনাটাই ধরেন। পারাপারের সময় রেলের উচ্চ সাইরেনের শব্দে হঠাৎ পায়ে মোচড় কেটে পড়ে গেলাম একদিন। যদিও স্বামীর হাতটা ধরেই পার হচ্ছিলাম সেদিন। কিন্তু কখন যে পা মচকে গেলো তা বুঝে উঠতে পারিনি। ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম আমি। নিমিষেই পায়ের গোড়ালিও দেখি ফুলে গম্বুজ হয়ে গেলো। চারপাশ থেকে মানুষ জড় হয়েছিল আমাকে তুলে দেওয়ার জন্য। দিল্লীর মতো একটা জায়গায় ভেবেছিলাম সহযোগিতার হাত হয়ত তেমন একটা পাওয়া যাবেনা। কিন্তু আমার সেই ধারনা পাল্টে দিল সেখানকার লোকজনেরা। কে কিভাবে সাহায্য করবে সেটা নিয়ে রীতিমতো একটা প্রতিযোগিতা শুরু হল। হঠাৎ অনুভব করলাম এত ভিড়ের মধ্য থেকেও ওর হাতটি শক্ত করে তখনও ধরে রেখেছে আমাকে। এক ভরসার প্রদীপ জ্বলে উঠলো মনে। “হ্যাঁ, আমি আছি। আমি আছি তোমার পাশে।” এই কথাটি যেন ওর নীরব চোখের চাহনিই বলে দিচ্ছিল।

তখন থেকেই শুরু হল আমার ডান পা ভোগান্তির গল্প। কথায় বলে না একটি দুর্ঘটনা আর সারাজীবনের কান্না। ঠিক তাই ঘটেছে এই আমার জীবনেও।
ডাক্তার মশাইয়ের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম আমার ডান পায়ের গোড়ালি বরাবর হাড়টা নাকি ভেঙে একটি আরেকটির ওপর উঠে গিয়েছে। কি জটিলতার মধ্যেই না পড়ে গিয়েছিলাম তখন। একদিকে স্বামীর গোয়েন্দার চাকরি, যেখানে ছুটি পাওয়া মুশকিল। অন্যদিকে আমার গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত প্লাস্টার করা পা, যেটা নাকি কিছুতেই নাড়ানো যাবে না। তার ওপর ঘরে আছে চারটা ছোট বাচ্চা। পায়ের এই দুরাবস্থা দেখে বাচ্চাগুলোর ঠোঁটের হাসি যেন বিলীন হয়ে গেলো। কারণ মাকে ঘিরেই যে ছিল ওদের সব বর্ণিল শৈশব। কে কি খাবে, কে কি পড়বে, কে কি খেলা খেলবে, সবই যে মাকেই ঠিক করে দিতে হতো। প্লাস্টার করা পায়ে সংসারের কাজে যখন হিমশিম খাচ্ছিলাম ঠিক তখনই বড় বোনের দিল্লীতে আগমন। বোনকে কাছে পেয়ে যেন আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। দীর্ঘ ছয়টি মাস অপেক্ষার পর এই কারাবন্দী প্লাস্টার থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছিলাম আমি।

কিন্তু কে জানতো অঘটন যে আমার পিছু ছাড়েনি তখনও। যেন চুম্বকের ন্যায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে আমাকে। সপ্তাহ খানেকের মাঝেই সেই ভাঙ্গা পায়েই আবার সিঁড়ি থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়লাম। এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার পাতিলা হাতে নিয়ে পড়লাম সেই একই পায়ের ওপর। ধীরে ধীরে অনুভব করলাম আমার হাঁটার গতিরও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ডান পা কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। শরীরের ভর নিতেও যেন একটু হিমশিম খায় এখন। পায়ে জোর না থাকলেও সংসারটা ঠিকই চালিয়ে গিয়েছি আমার মনের জোর দিয়েই।
অশ্রু নিয়ে একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয় এই পৃথিবীর বুকে। খিল খিল হাসির শব্দে আপন করে নেয় এই ভুবনকে। আবার কিছু স্মৃতি সাথে নিয়ে বিদায় নেয় এই দুনিয়া থেকে। তাই আমাদের জীবনও এই অশ্রু, হাসি ও স্মৃতির বেড়াজালে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। অশ্রু শুকিয়ে গেলেও, হাসি ম্লান হলেও, স্মৃতি কিন্তু চিরকাল অমলিন হয়ে থাকে। চোখের সামনে স্মৃতি অদৃশ্য থাকলেও তা হৃদয় দিয়ে অনুভূত করা যায় গভীরভাবে।
আইরিন ফাহিনূর সুলতানা, মহাখালী ( ঢাকা)