আইরিন ফাহিনূর সুলতানা
আমার মায়ের জীবনের কথা নিয়ে আজ রয়েছে তৃতীয় পর্ব। জানিনা আমার মায়ের জীবনের গল্পগুলো পড়তে আপনাদের কেমন লাগছে। কিন্তু আমি এতে পরম তৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছি। তবে এই গল্পগুলো হয়তো আপনাদের অনেকের ছোটবেলা বা অতীতের সাথে মিলে গেলে যেতে পারে। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো মানুষদের বুকে হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাসও নেমে আসতে পারে।
সামনে আসছে ঈদ। মন স্থির করলাম ঘরটাকে গোছাবো এক নতুন সাজে, নতুন রুপে। কিন্তু ঘরের সেই পুরনো পর্দা যে চোখে আঁটকে, ঠিক যেন মাছের কাঁটার মতন। বড় বড় ঢোঁক গিললেও কিছুতেই হজম হয়না। তাই বসে পড়লাম নতুন পর্দা বানাবো বলে। নিবিড়ভাবে চলছে সুই সুতা দিয়া সেই পর্দা বুননের কাজ। কাঁচি হাতে নেয়া মাত্রই মনে পড়ে গেলো, নতুন সংসারের নতুন পর্দার সেই পুরানো ইতিহাস।
বড় মেয়েটির স্কুল শুরু হয়েছে কেবল। নতুন স্কুলের নতুন আমেজে মহা খুশি সে। ভাব দেখে যেন মনে হয় আমি না, ওই বোধ হয় আমার মা। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে অবসর কাটাতাম আমি। এই শখ বুঝি এখনও পিছু ছাড়ে না আমার।

একদিন মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখল, ঘরের দেয়ালে নতুন পর্দা ঝুলছে। খুব খুশি মনে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো, “মা, এই পর্দা কি তুমি বানিয়েছো? খুব সুন্দর লাগছে তো। আমিও তোমার মতো পর্দা বানাবো। ঠিক আছে মা…। বলনা ঠিক আছে মা…আমিও পর্দা বানাবো…।” রান্নার কাজের মাঝে মনের ভুলেই ওর পর্দা বানানোর বায়না শুনে অনুমতি দিয়ে দিলাম। “ঠিক আছে, তোমার যা খুশি তুমি তাই কর। কিন্তু আমার আর মাথা খেও নাতো…।” এই কথা বলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মেয়ের জ্বালা যন্ত্রণা থেকে কিছুটা রেহাই পাবো ভেবেছিলাম।
কিন্তু রান্না ঘর থেকে ফিরে এসে দেখি, নতুন পর্দা গুলোর মধ্য থেকেই আমার মেয়ে কিনা ওর পর্দা বানানোর কাপড় খুঁজে বের করলো। হাতে একটা কাঁচি নিয়ে, দর্জি বেশে বিলাসসিতা মনে কেটে যাচ্ছে সব পর্দার কাপড়। দেয়ালে টাঙানো সেই পর্দা মাঝ বরাবর কেটে, আমার মেয়ে বুঝি আকাশের সুয্যি মামাকে ঘরে উঁকি দিবার নিমন্ত্রণ জানালো। পর্দাগুলোর এই দুর্দশা দেখে মোনালিসার সেই ছবির মতন আমারও চোখে অশ্রু আর ঠোঁট বাঁকানো মুচকি হাসি চলে এলো। কারণ পর্দা বানানোর অনুমতি তো আমিই দিয়েছিলাম ওকে। তাই বলে নতুন পর্দার কাপড়ই যে সে বেছে নিবে সেটা তো ভাবিনি কখনও। অনিদ্রায় কাটানো কত রাতের সব কষ্ট মেয়েটা কিনা নিমিষে ধুলোই মিশিয়ে দিলো। এই কথা ভেবেই আবার একটু রক্ত গরম হয়ে পড়লাম। কি করবো বুঝে ওঠার আগেই রাগের মাথায় মেয়েকে সামনে রাখা টিভি স্ট্যান্ডের ওপর বসিয়ে দিলাম। অবুঝ মেয়েটি আমার তখনো বুঝে ওঠতে পারেনি যে, সে আসলে কি অপরাধটাই না করেছে। নিজের অপরাধের কথা অবশ্য কেই বা স্বীকার করবে।

মেয়েটার কাটাকুটির স্বভাবটা আর বুঝি গেলনা। কখনও আমার শাড়ির আঁচল কেটে ওড়না বানাত, কখনও আবার বিছানার চাদর কেটে পুতুলের জামা বানাত। কাপড়ের টুকরো গুলো আমিও চোখের আড়াল করেই রাখতাম ওর বাবার কাছ থেকে। আসলে মেয়েকে শুধু একা দোষ দেয়াটা ঠিক হবেনা আমার। মেয়েরা নাকি মায়ের ছায়া ধরেই চলে। ঠিক যেমন আমি ছিলাম ছেলে বেলায়, মেয়েতো সেই একি পথে কিছুটা হলেও হাঁটতে চাইবে। এটাই তো মাতৃত্ব জীবনের ঘূর্ণায়মান খেলা ।
আজও মনে পড়ে স্কুলের সেই ছোট্ট আমি। যে আমি ছিলাম দলের নেতা, দুষ্টুমির সেরার সেরা। করতাম শুধু খুনসুটি আর খেতাম শুধু টিচারের ভালোবাসা মাখা বকুনি। যা কিনা খোলা চিঠি দিয়ে যায় এখনও স্মৃতির দুয়ারে। আর চোখের পাতায় এঁকে যায় দুরন্ত শৈশবের দিন, যে দিনগুলো ছিল প্রফুল্লের রংতুলির রঙে রঙিন।
টিফিনের ঘণ্টা শোনা মাত্রই কোনও না কোনও বন্ধুকে ফাঁদে ফেলার ফন্দি রটতে থাকতাম। কখনও জুতার ফিতা দুটো বেঁধে আবার কখনও সীটের ওপর পানি ঢেলে। আজও মনে পড়ে বন্ধুদের পিছনে লেজ বানানো সেই কাগজের কথা। কাগজ হাতে আশা মাত্রই আগে টার্গেট সেট করতাম, যে কাকে লেজ বিশিষ্ট মানব বানাবো। বন্ধুরা যখন আড্ডায় মশগুল থাকতো, ঠিক তখনই হাতে লুকিয়ে রাখা কাগজটির মাঝ বরাবর গোল করে কেটে, ওদের পেছনের ঝুলে থাকা জামাটি কাগজের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিতাম। এইতো হয়ে গেলো আমার লেজ বিশিষ্ট মানব। সেই অবস্থায় কেও যদি বোর্ডের সামনে হেঁটে যেতো, ব্যাস সবার অট্টহাসিতে স্কুল কেঁপে উঠত। আমিও তখন মনের আনন্দে একটি গানের লাইন গুনগুন করে গেয়ে উঠতাম, “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…”। বন্ধুরা কেও ধরতেও পারতো না আসলে ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে।

স্কুলের পর কেটে গেছে অনেকটা বছর। যে যার মতন বাঁচতে শিখে গেছে। কিন্তু হঠাৎ এক পুরোনো বন্ধু দেখি আমার দুয়ারে এসে হাজির, ‘কিরে কেমন আছিস?’ চোখের সামনে ঝলমল করছে কত বছর দেখা না হওয়া হাসি মাখা মুখটা। দুদিকে বেণী করা ছোট্ট মেয়েটির মুখ এখন সংসারী। চোখে মুখে আছে গাম্ভীর্যের ছাপ। চুলেও দেখি বয়সের ছাপটাও চলে এসেছে। আমারও বুঝি সেই একি দশা। কালের পরিসীমা অতিক্রম করে আজ আমরা প্রত্যেকেই বুড়ো হওয়ার পথে। তাইতো নিজের সন্তানদের মধ্যে দেখতে পাই নিজেদের প্রতিচ্ছবি। ওদের মধ্যে দিয়েই নতুন করে আবার নিজেকে খুঁজে পাই । এইতো চলছে জীবন।
আইরিন ফাহিনূর সুলতানা, মহাখালী (ঢাকা)
পড়লাম! খুবই ভালো লাগলো! আমার নিজের শৈশবে ফিরে গেলাম কিছু সময়ের জন্য! 🥺 অনেক ভালোবাসা আন্টি ও তোমার জন্য 💖💖💖