আইরিন ফাহিনূর সুলতানা
আমার মায়ের জীবনের গল্প নিয়ে আজ লিখছি দ্বিতীয় পর্ব। এ লেখা কেবল শুধু মায়ের স্মৃতির খাতা মেলে ধরা নয়। চেষ্টা করছি আমার মাকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও পুরনো দিনের আনন্দগুলো ফিরিয়ে দিতে।
ঘড়ির কাঁটার টিকটক শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো। বিকেলের ঘুম বুঝি চোখে ধরে না বেশি। টিনের চাল গড়িয়ে টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা যেন ছন্দে ছন্দে তাল মিলিয়ে গাইছে। কি এক অপরূপ ধ্বনি। জানালার পাশে বসে সেই ছন্দে দুই পা দোলাতে দোলাতেই খেয়াল করলাম বৃষ্টির ফোটাগুলো জানালার কাঁচে যেন এক স্মৃতির জলছবি এঁকে দিলো। ঘোলাটে সেই বৃষ্টি ভেজা দিনগুলোর শীতল হাওয়া যেন অন্তরে ছোঁয়া দিয়ে গেলো।

দিল্লীতে তখন আমাদের বসবাস। স্বামীর সরকারি চাকরির কারণে অহরহ এরকম বদলি হতে থাকে। নিজ দেশ ছেড়ে দূরপ্রবাসে একাকি অজানা পথে পাড়ি জমানো যেন নিজের সাথে প্রতিনিয়ত এক নিজেরই দ্বন্দ্ব। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে চলাটাও বড়ই কঠিন। পথে ঘাটে দেখি না কোন চেনা মানুষ। ভাষার ওপর দক্ষতা আনাও ছিল এক পরীক্ষার সমতুল্য। এক বৃষ্টির দিনে হঠাৎ বাড়িওয়ালা এসে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “বাহার বহত বারিশ হও রাহি হ্যাঁ, তুম লোগ সাব আন্দের চালে যাও”। কি এক মুশকিলেই না পড়ে গেলাম তখন। একে তো তখনও হিন্দি আয়ত্ত্বে আসেনি। তার ওপর বাচ্চাগুলো নিয়ে ছিলাম একা বাড়িতে। ল্যান্ড ফোনের সংযোগও তখন নেয়া হয়নি। শব্দগুলো তাই পুনরায় ভেঙে বোঝার চেষ্টা করলাম। “বাহার… সাব… চালে যাও”। তাহলে কি আমদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ওরা।
একটু অভিমানী হয়ে সত্যিই বেরিয়ে পড়লাম নতুন বাসার সন্ধানে। কি বোকামিটাই না করেছিলাম সেদিন। বড় মেয়েটা কেবল একটু বুঝতে শুরু করেছিল। তাই ওর কাছেই ছোট গুলোকে রেখে বেরিয়েছিলাম নতুন ঠিকানা পাবার আশায়। বৃষ্টি বাদলের দিনে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগলাম। যদি কোথাও একটি বাসা খালি পেয়ে যাই। হঠাৎ ফেরার পথ গুলিয়ে ফেললাম। ওদিক দিয়ে বাড়িওয়ালা এসে বাচ্চাগুলোকে একা দেখে, ওদের বাবাকে ডেকে খুলে বলল আসল কথা। আমাকে ঘরে না দেখতে পেয়ে ওর মাথায় যেন রীতিমতো বাজ ভেঙে পড়ল।

কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। তুমুল বৃষ্টিতে চারপাশ ঘোলা ঘোলা লাগছে। আমি এক দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে একদল মানুষ সামনে মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। কি অবাক করা বিষয়। অচেনা শহর,অদেখা গলি, অজানা মানুষ- এর মাঝ থেকে ওর চোখ দুটো ঠিকই আমাকে খুঁজে নিলো। আমাকে হারিয়ে ফেলার এক ভীতি তার দু চোখ জুড়ে ভেসে উঠল। বুকের সেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন ভোরের শিশির বিন্দুর মতো আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আমার হৃদয়কে। নীল আকাশ যেন তার রংধনুকে ফিরে পেলো। আর আমি কিনা সেই বন্ধুত্বের মাঝে খুঁজে পেলাম আমার ভালোবাসাকে।
অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কখন যেন বৃষ্টি ভেজা জানালাটি ঝড়ো বাতাসের বেগে খুলে গেলো। ঝির ঝির বৃষ্টির ফোটা এসে চোখে মুখে এসে পড়লো। একি অশ্রু ঘেরা নয়ন নাকি বর্ষার জল বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে এক কাপ চা খাওয়ার মিনতি এসে পড়ল। বৃষ্টি বাদলের দিনে এই চা এর আকুতি যে মনে অন্য এক তৃপ্তি এনে দেয়। গরম চায়ের এক চুমুকেই হৃদয় জুড়িয়ে যায়। মনের বাগানে প্রস্ফুটিত হয় হাজারও ফুলের সুবাস।

চায়ের পাতিল চুলায় বসিয়ে পাশে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। উনুনের আগুনের তাপ যেন প্রথম রসুই ঘরের ছন্দে মাতিয়ে দিলো আমায়। একটু মুচকি হেসে বিড়বিড় করে সেই ছন্দে তাল মিলিয়ে আমিও গেয়ে উঠলামঃ
“ এই রান্নার সাথে পরিচয় তো ছিল বহুদিনের আমার, তবে চা আর ডিম ভাজি ছাড়া যে কিছুই পারতাম না তখন। কাটাকুটিতেও আমার ছিলো না তেমন পাকা হাত। তাই বেশিরভাগ খাবারই অপচয়ই হয়ে যেত আমার। নাড়তে গিয়ে হাঁড়িতে হাত লেগে খেতাম ছ্যাঁকা, কেউ জানে না রুটিটি আমার হয়ে যায় কেন বাঁকা। ডালেও আমি দিতে পারতাম না ঠিক মতোন বাগার, পরোটাও পেতো না আমার কোনও গোল আকার। মাথা খাটিয়ে ভাবতাম মুরগীটি কাঁটি কি করে, মাছ গুলোও দেখি চেয়ে থাকে মোর কাঁচা রাঁধুনির হাতে। রান্নাও অল্প স্বল্প যেতো আমার জ্বলে, ঠিক ঠাক করলেও তবু কিছু একটা যেতাম ভুলে। এরই মাঝে শশুর বাড়ির সব লোকজন এসে হাজির, কি করি তা ভাবতে যেয়ে চোখে জল এলো ঝিরি ঝিরি। স্বামী মশাই হেসে বলেন, ওগো কাঁদছো কেন তুমি? সঙ্গে আমি থাকতে তোমার, এত ভাবছো কেন তুমি? দুজন মিলে সব রান্না সেরে পার করলাম অতিথিদের, ওগো তোমার হাতে হাতটি রেখে বলো ধন্যবাদ জানাই কি করে। ”

গুনগুন করতে করতেই চায়ের পাতা উপচে পড়ে গেলো। কি যে ছেলে মানুষী করে বসি না আমি মাঝে মাঝে, এই ভাবনায় মশগুল হয়ে কাপে চা ঢেলে নিয়ে গেলাম ভেতরে। একসাথে দুজন বসে এই চায়ের চুমুকে চুমুকেই সারাবেলার সব জমানো কথা ঝেড়ে ফেলি।
আমাদের জীবনের এই মিষ্টি মধুর স্মৃতিগুলো মনের মাধুরি মিশিয়ে যতনে লালন করতে হয়। আজও তাই সেই মনের কোণে পড়ে আছে খণ্ড বিখণ্ড স্মৃতি বিজড়িত সেই টুকরো গুলো। রাখা না রাখার ক্যানভাসে জীবন শুধু নিঃশেষের পথে হেঁটে যায়। একসময় আবার সেটাও ফুরিয়ে যায়। তাই মাঝে মাঝে পুরনো সেই দিনের কথা আমাদের মনে উঁকি দিলে ছবিগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়া উচিত। না হলে হয়তো একদিন কোথাও বিলীন হয়ে যাবে সেই সোনালি দিনগুলি।
আইরিন ফাহিনূর সুলতানা, মহাখালী(ঢাকা)