আইরিন ফাহিনূর সুলতানা
মা একটা বিন্দুর মতো, যাকে কেন্দ্র করেই জীবন পরিধি আঁকা যায়। মা একটা মায়া ঘেরা আঁচল, এ যেন এক সুরক্ষার মোড়ক। মা মানে এক ঝুড়ি ভালোবাসা, আবার অশ্রুসিক্ত নয়নে বুকে জড়িয়ে ধরা। আমার মায়ের নাম জেবুন্নাহার করিম। মায়ের জন্য, মায়ের নিজের জীবনের কিছু গল্প নিয়ে আমি আইরিন ফাহিনূর সুলতানা আজ থেকে লিখছি রোকেয়ানামায়। আশা করছি আমার মায়ের জীবনের কথাগুলো আপনাদের ভাল লাগবে।
আয়না, আমাকে আজ দেখেও দেখো না; কখনও অলংকৃত আমি, কখনও আবার নিরাভরণ হয়ে চেয়ে থাকি তোমার দিকে। যদি কোথাও খুঁজে পাই আমার প্রতিবিম্বের আয়না, এই প্রত্যাশায় প্রতিদিন দুই নয়নের তারায় তোমায় খুঁজি। কিন্তু দেখা পায়না সেই আমাকে। ব্যস্ততার বেড়াজালে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলতে চলেছি। মনে হয়, একছুটে পালিয়ে যাই স্মৃতির ঐ ছিন্ন পাতার আড়ালে, যেখানে লুকোচুরি খেলছে আমার ফেলে আসা দিনগুলি। সেই পুরনো স্মৃতি গুলো যে বড্ড দামি হয়ে গিয়েছে আজ আমার কাছে। ছেলেবেলার খাতার শেষ পাতায় শুরু হতো আমাদের গল্প। কাটাকুটি খেলা, ভাললাগার মানুষটির নাম লেখা, আবার তার ওপর হিজিবিজি করে দেওয়া, যাতে মা বুঝতে না পারে।
সত্যি বলতে, ওখানেই আমরা ছিলাম, আসলে আমরা স্কুল ছুটি হলে কখনও বা স্কুল পালিয়ে, লাটিম কিনতে যাওয়া, বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে পিটুনি খাওয়া। সেসব দিন কেবলই স্মৃতিকাতর করে তোলে আমায়। নতুন কেনা রঙিন লাটিম দিয়ে কাউকে হারিয়ে দেওয়ার যে সুখস্মৃতি, তা এখনো চোখে লেগে আছে। আবার চোখের সামনে নিজের রঙিন লাটিমটিকে ক্ষত বিক্ষত হতে দেখার স্মৃতি এখনো আমাকে কষ্ট দেয় নিজের অজান্তেই।
বিকেলের চুরিয়ে যাওয়া আলোয় এলাকার এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে নিয়ে কানামাছি খেলার সেই ছন্দ ও সুর এখনও কানে ভেসে আসে। বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায়, ঘরের কোণে, অথবা গাছতলায় সংসার সাজাতাম খেলার ছলে। কে জানতো একদিন এই সংসারের মাঝেই নিজেকে হারিয়ে ফেলবো আমি চিরতরে। চোখে মুখে সেই দুষ্টমির ছাপটা আজ আর নেই। ব্যস্ততার চাপে এখন শুধুই ক্লান্তি।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজ হঠাৎ এসব কথা ভাবছি কেন? কেন আবার ছুটতে মন চাইছি ময়ূরাক্ষীর তীরে? কেন মনে হচ্ছে ভালোই হতো সময়টা যদি তখন যেত থেমে। আসলে স্মৃতি হয়ে যাবার জন্যই প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের সামনে আসে। গল্প হয়ে যাওয়া দিনগুলো পড়ে থাকে পুরনো ক্যালেন্ডার জুড়ে। তখনই দুই নয়নের কাঠগোড়ায় এসে দাঁড়ালো পেছনের দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের পাতা। লাল বৃত্তে ঘেরা ২৩ শে নভেম্বর তারিখটি যেন কপালের লাল টিপে পরিণত হয়েছে। চোখে নেই কোনো কাজল, মুখে নেই সেই মিষ্টি হাসি, পায়ে নেই আলতা আর নূপুর, পরনে নেই সেই লাল শাড়ি। লাল রঙ নিয়েও কাউকে যে মাঝে মাঝে কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে হয় তা আগে কখনও ভাবিনি।
ক্লান্ত চোখের চশমাটা খুলে মুখ তুলে তাকালাম। এই বুঝি আমি, যে কিনা বধূ বেশে এই দিনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। কত শত চশমা বুকের আলমিরায় লুকানো, কতগুলো ঝুলে আছে পাঁজর ভাঙ্গা দেয়ালে, বেঁচে থাকার চাহিদায় রোজ একটি বেছে নেই, ধূসর কাঁচে ধুলো মুছে হেঁটে যাই নিজেকে ফিরে পাবার আশায়। দিন আসে, দিন যায়। দেখতে দেখতে বিয়ের চল্লিশটি বছর কেটে যায়।
এই তো সেদিনের কথা, বাসন্তী শাড়ি আর ঘন কালো চুলে লম্বা একটি বেণী, হাতে এক গুচ্ছ বই নিয়ে হেঁটে চলেছি ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নামটি যেন রয়ে গেছে এখনও স্মৃতির ক্যানভাসে। যে নামটি মনে পড়তেই চোখের সামনে ক্যাম্পাস জীবনের হাজারো মধুর স্মৃতি ভেসে ওঠে। রোকেয়া হলের সামনে হঠাৎ দেখা হলো এক বান্ধবীর সাথে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ‘হাকিম ভাই’ এর সেই চায়ের দোকানে। দোকানটি ছিল একেবারেই সাদামাটা। বসার জন্য তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। ইটের উপর কয়েকটা তক্তা সাজানো এই যা। ওখানেই জমে উঠতো আমাদের তুমুল আড্ডা।
আজও মনে পড়ে ইটের তক্তাতে বসে বন্ধুদের সাথে এক চুমুক চা মুখে দিতেই কানে ভেসে আসতো প্রগতিশীল ছাত্রদের মিছিলের স্লোগান। কি এক অদ্ভুত অনুভূতি। মাঝে মাঝে আমিও দাঁড়িয়ে যেতাম মিছিলের শেষপ্রান্তে। সংগ্রামী চেতনার লড়াকু নেতাকর্মীর অংশই মনে হতো নিজেকে। বন্ধুরা উপহাস করে বলতো আমার ছবিতে পত্রিকার পাতা মুখোরিত হবে একদিন। সেইদিন এখন শুধুই স্মৃতির পাতায়। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রতিটি বইয়ের মোড়কেও ছড়িয়ে রয়েছে বন্ধুদের স্মৃতির ছাপখানা। সেখানে ছিল নীরবতার মাঝেও ইশারার কথোপকথন। আজও মনে পড়ে গ্রন্থাগার থেকে টিএসসি প্রাঙ্গণের সেই মিলনমেলা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।
ক্যাম্পাস আঙিনার কোলাহলে নিজেকে আকাশের অফুরন্ত পক্ষীকূলের মতো মনে হতো। সুদূর আকাশের সেই স্বাধীনচেতা পাখিও একদিন বাস্তবতার পিঞ্জরে এসে আবদ্ধ হয়। এরই নাম কি জীবন! রঙিন চশমাটা খসে যেতেই আজ পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা সামনে চলে এলো। ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখি একদল অতিথির আনাগনা। অচেনা এই চেহারার মুখগুলো যেন থমকে তাকাচ্ছে আমার দিকে।
নিজেকে একটু অপ্রস্তুত মনে হলো আমার। মনের গভীরে এক রহস্যের উন্মোচন হলো। পেছন থেকে মা এসে নিয়ে গেল আমাকে। হঠাৎ বসিয়ে দিল সেই অচেনা মুখগুলোর মাঝে। জল ছাড়া মৎস্যের মত একবিন্দু জলের জন্য কাতরাচ্ছিলাম মনের অজান্তেই। তখন থেকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসার আয়োজন শুরু হয়ে গেল ক্যাম্পাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে। আল্পনা ঘেরা জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন নীরবতাই শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। চারিদিকে মানুষ থেকেও হঠাৎ হয়ে গেলাম জীবন তরীর সেই মাঝি যে কিনা বাইছে নৌকা একা।
যখন আমরা একসাথে নতুন জীবন শুরু করেছিলাম, আমরা পরস্পরের কাছে ছিলাম শুধুই অজানা। ভাগ্যে আছে লিখা, কার সাথে কার হবে দেখা। কেউ জানে না কবে কখন, কার সাথে গিয়ে মিলবে এই জীবন। তবুও থাকে একটি চাওয়া, মনের মতো বন্ধু পাওয়া। হ্যাঁ, সেই বন্ধু আমি পেয়েছি বটে। বন্ধুত্বের এমন বাঁধনে বেঁধেছি নিজেকে যে আর চাইলেও ডানা মেলে একা উড়তে পারবো না দূর দূরান্তে।
দূরত্বের মাঝেও যে ভালোবাসার দীপ প্রদীয়মান থাকে তা উপলব্ধি করলাম এই সংসার জীবনেই। স্কুল পড়ুয়া চারটি সন্তানের জননী তখন আমি। জীবনের সবচাইতে কঠিন মুহূর্ত তখনই আসে যখন হঠাৎ শুনি স্বামীর বদলি হয়েছে সেই পার্বত্য অঞ্চলে। ল্যান্ড ফোনের সেই দিনগুলোতে দীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো আমাকে, যে কখন তার কণ্ঠ এসে নাড়া দিবে অন্তরে। মাঝে মাঝে মনের কথাগুলো ফুটিয়ে তুলতাম পত্রের পাতাগুলোতে। অবাক করা বিষয় ছিল সেই পত্রগুলো কখনও ডাকে দেয়া হতো না আমার। অপেক্ষাতে দিন ফুরিয়ে গেল, রাত ফুরিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল একটি নয়, দুইটি নয়, তিন তিনটি বছর। আমার ছন্দে তাল মিলিয়ে অপেক্ষারাও ভাবছে বুঝি কবে সেই অপেক্ষা শেষ হবে। হয়তো অপেক্ষাই জানে ভালোবাসার মানে।
আজ অনেকদিন পর মনের জানালায় হাজারো স্মৃতির ভিড় জমেছে। কি করবো বলো, বয়স যে আজ ৬৫ তে এসে ঠেকেছে। পাড়ার মাইকে ভেসে আসছে একটা পুরনো কবিতা। হয়তো বা সেটা শুধু আমাকে নিয়েই লেখা। কেন জানি নিজেকে আজ খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। তাইতো এসে দাঁড়িয়েছি এই আয়নার সম্মুখে। ক্ষমা প্রার্থী আমি স্বয়ং নিজেরই কাছে। কখনও বাকরুদ্ধ হয়ে, আবার কখনও অশ্রুসিক্ত নয়নে। স্বপ্নের ডানা কেটে পুড়িয়েছি বারংবার বলে। শৈশবের চাঞ্চল্যতা ভুলে সাজিয়েছি এই সংসারটাকে।
হঠাৎ এক ছায়া এসে দাঁড়ালো আমারই ছায়ার পাশে। নিজের অস্তিত্বকে আবার ফিরে পেলাম সেই সঙ্গী ছায়ার মাঝে। বেদনা সব মধুর হলো তার সুরের মূর্ছনাতে।
“শুনতে কি পাও তুমি আকাশের এই গুঞ্জন,
দেখতে কি পাও তুমি মেঘের এই চাহনি,
তবে এই অশ্রু কেন?
চলো ছুঁয়ে দেখিনা এক ফোটা বৃষ্টির পানি,
ফোটায় ফোটায় শুনতে পাবে,
কতোটা তোমায় ভালোবাসি আমি।“
মনের দর্পণে ক্ষণে ক্ষণে, চোখের গভীরতাই যেন মুখের বুলি হয়ে ওঠে।
“নিরাশার আঁধারে তোমার এই বাণী,
মুছে দিল আমার জীবনের সব শূন্যতার গ্লানি।“
আইরিন ফাহিনূর সুলতানা, হোমমেকার ( মহাখালী, ঢাকা)
😲 WOW!!!!!!
তুই এত ভালো লিখিস!!!!
মাশাআল্লাহ!!!!
অসাধারণ লিখেছ। মনে হচ্ছিল কোন সাহিত্যিক এর লিখা পড়ছি। পরবর্তী পর্বের অপেহ্মায় রইলাম
খুবই সুন্দর লিখনী ❤️