23

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে সুখ খুঁজে আনি

Share

জেমী সুলতানা

বাবার বাড়ির বড় মেয়ে, শ্বশুর বাড়িতে এসে হলাম বড় বউ।  সম্পর্কে বড় হলেও এখানে ছিলাম বয়সে সবার  ছোট। তাই আমাকে নিয়ে বাবা মায়ের টেনশনের কোন শেষ  ছিলোনা। “মেয়েটা মানুষই চিনতে শিখেনি এখনও, বৈষয়িক জ্ঞান কম, বড় পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো নিতে পারবে তো! জগতের ভাবসাব বুঝবে কি করে! এখনও তো নিজেকেই সামলানো শিখেনি ”  অথচ এই জগত না চেনা, কিছুই না বুঝা মেয়েটার কিন্তু ঠিকই বিয়ের বয়স হয়েছিলো। নিজেকে সামলাতে না শেখা মেয়েটিকে অনেক বড় পরিবার সামলানোর জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। যে কোনো মেয়ের জন্যই শ্বশুর বাড়িকে প্রথমেই বাবার বাড়ি মনে করা ভুল হবে। এখানে কেউ কাউকে আগে থেকেই চিনেনা, জানেনা। আসা মাত্র সবাই আপনাকে উজাড় করে ভালোবাসতে থাকবেনা। 

এখানে সবার মনে জায়গা করে ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। আর এ লড়াইটা কেবল একার। নিজের সকল চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে  শ্বশুর বাড়িকে বাবার বাড়ির মত বানাতে অনেক অনেক বছর লেগে যায়। সবাইকে খুশি রাখতে রাখতেই  মেয়েরা একসময় সাংসারিক হয়ে উঠে। আর এই মেয়েগুলাই হয়তো লক্ষী বউ হিসেবে স্বীকৃতি পায় একসময়। অথচ নিজেকে উৎসর্গ করা সেই আমিটাকে আমার দু:খগুলোকে কেউ ছুঁয়ে দেখেনা।ছোটবেলায় ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে এমন কিছু হবো যেনো পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারি। কিন্তু বড় হতে হতে, ক্যারিয়ার গোছাতে গোছাতে বিয়ে হয়ে গেলো। ভাবলাম বরের সাথেই না হয় দুনিয়া দেখবো। কিন্তু স্বপ্ন আর সংসার দুটোই আলাদা বিষয়। বাবার ঘরে মেয়েরা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখে, কিন্তু স্বামীর ঘরে এসে সেই স্বপ্নগুলো হয়ে যায় সংসার।  এটাই বাস্তবতা। এটাই সত্য। তখনও পড়াশোনাটা শেষ হয়নি। ছাত্রী অবস্থায় পাত্রী হয়ে যেদিন ছেলেপক্ষের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল সেদিনই বুঝেছিলাম পরবর্তী গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে বারোটা বেজে যাবে। তারপরও চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম যেভাবেই হোক পড়াশোনাটা  ড্রপ করা যাবেনা। বাড়ির বউয়ের পড়াশোনা করাটাও ছিলো সেকেলে মানুষদের কাছে কিছুটা দৃষ্টিকটু।   

প্রথম দিকে সব নর্মাল হলেও ছোট বাচ্চা বাসায় রেখে ভার্সিটি যাওয়াটাও অনেকে মেনে নিতে পারতেন না। আবার দেখলাম ছেলেটাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েও আর পেরে উঠা যায়না। ক্লাসের দরজা ধরে মাকে উঁকি দিয়ে দেখতো। আমার ছোট্ট ছেলেটার নীরব কান্না আমিও মেনে নিতে পারিনি।  তাই পরীক্ষার দিন ছাড়া খুব একটা ক্লাস করা হয়নি। কাউকে আলাদা করে দোষ দেয়া চলেনা। সবার উপর পরিবার, এই কথাটা নিজের মাকে দেখেই শিখতে শিখতে বড় হয়েছি। বিয়ের পর দায়িত্বগুলো তাই এড়িয়ে যেতে পারিনি। ঘর ভর্তি মানুষ, ১০ টা থেকে পরীক্ষা শুরু, ইডেনের মেয়েদের সীট পড়েছিলো বদরুন্নেছা কলেজে। সকালের রান্নাটাও বাকি। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে ভাতের ফ্যান ফেলতে গিয়ে সকাল সকাল হাতটা অনেক খানি পুঁড়িয়ে ফেলেছিলাম। সেই পোড়া হাত দিয়ে সেদিন পরীক্ষায় খাতায় লিখতে কত যে কষ্ট হয়েছিলো!! এমনি নিত্য নতুন কত শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে ডিপার্টমেন্টে টপ রেজাল্ট করা অতটাও সহজ ছিলোনা। রেজাল্ট শেষে দেখা গেল আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। পড়তাম ইংরেজি সাহিত্যে। ভালো রেজাল্টের দাম দিতে সবাই জানে। তখন প্রতিদিনই কারো না কারো ফোন, কত কত জব অফার এসে জমতো হিসেব ছিলোনা। 

 কিন্তু এরই মধ্যে নিজের অজান্তে পরিবারের সবাইকে কবে যে  আমি আমার নিজের উপর সম্পূর্নভাবে  ডিপেনডেন্ট বানিয়ে ফেলেছিলাম বুঝতেই পারিনি। দায়িত্ব ক্রমশ বেড়েই গেলো। এত বড় পরিবারের কেন্দ্রে থেকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার আর বাইরে গিয়ে কিছুই করা হলো না। না হলো চাকরি বাকরি, না হলো দেশ বিদেশে ঘোরাঘুরি। দেশ বিদেশ দূরে থাকুক, আমি নিজের দেশের রাস্তা ঘাটেও হিমশিম খাই। ইডেন কলেজের মেয়ে হয়েও আমি পথ ঘাট চিনেনা, এটা মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন ছিলো। সবসময় বাসায় থাকা ঘরকুনো মানুষগুলো বুঝি এমনি হয়।  বাইরের জগতটা একেবারেই অচেনা সেইসাথে মানুষগুলোও। 

একটা বিষয় কি, সবসময় বাসায় থাকাটা  কঠিন হলেও আফসোস কিন্তু হয়না এখন। আমি জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্র থেকে খুশি খুঁজে খুঁজে বের করে এনে সুখী হতে জানি। দু:খকে লালন না করে এর ভেতরেই সুখ খুঁজে নিয়েছি। না হয় সারাজীবন আফসোস নিয়ে একটা জীবন পার করতে হতো। আমি সেটা চাইনা। ভেবে নিলাম অন্যরকম জীবন আমি ডিজারভই করিনি। হয়ত চাওয়াতেই কোথাও ভুল ছিল কিংবা হতে পারে ওভাবে শক্ত করে কোনোদিন চাওয়াই হয়নি কখনও। মন থেকে ডিটারমাইন্ড সেভাবে ছিলাম কি!!  আমার বেলায় ঠিক কোনটা যে সত্য এটা আর মাপার দরকার হয়নি। কারন আমি তো ভালোই ছিলাম, আটারো বছর ধরে ভালোই আছি। চাকরি করলেও তো একটা মেয়েকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হয়। বিষয় হচ্ছে সম্মানটা পাচ্ছি কিনা। আমার পরিবার আমাকে পুরো সম্মানটা দিচ্ছে। সংসারের প্রতিটা মানুষ এখন আমার সিদ্ধান্তের উপর ডিপেন্ড করে।  

কষ্ট করে যতটুকুই কোয়ালিটি অর্জন করেছি তা শতভাগ নিজের পরিবারের পিছনে ব্যয় করা, ঘর সংসার অর্গানাইজ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের সমস্যার কুইক সমাধান করে দেয়া, বাচ্চাদের পড়াশোনায় হেল্প করা, ফ্যামিলির যে কোনো বড় বড় সিদ্ধান্তে প্রধান ভুমিকায় থেকে সবার ফিউচার প্ল্যান মোতাবেক বাস্তবায়নে তাদের সাথে থাকা।  আলাদীনের প্রদীপ স্বরূপ সবসময় সবার জন্য যেকোনো টাইমে যেকোনো কাজে প্রস্তুত থাকা, সবার ছোটো ছোটো ইচ্ছে-পূরণে নিজের বড় বড় ইচ্ছেগুলো ভুলে থেকে, মেনে মানিয়ে নেয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে টিকে থাকাও কিন্তু বিশাল গুণ।  এসবে যে ‘খুশি’ খুঁজে পায়, সুখে থাকতে তাকে কে ঠ্যাকায়!! চলার পথ সবার এক রকম স্মুথ কখনোই হবেনা। এটাই স্বাভাবিক। পরিবারের কেউ কেউ ক্যারিয়ার সচেতন হবে, ভাই বোনদের মধ্যে অনেক সাক্সেসফুল হয়ে এগিয়ে যাবে । আবার কেউ কেউ সব কিছু স্যাক্রিফাইস করে সংসারে অন্যদের সাক্সেস করতে গিয়ে কয়েক যোজন  পিছিয়ে যাবে। 

যে কোনো  সাক্সেসফুল নারী বা সাক্সেসফুল পুরুষ, দুজনের ক্ষেত্রেই কোথাও না কোথাও একজন হোমমেকারের বেতন বিহীন আজীবনের নিরলস পরিশ্রম রয়েছে যা আপনি আমি কখনোই অস্বীকার করতে পারবোনা। কে জানে,  হয়ত এটাও নিয়তির ব্যালেন্সিং প্রসেসগুলোর মধ্যেই একটি, যার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর অনেক কিছুই এখনও টিকে আছে।

জেমী সুলতানা, হোমমেকার