জানা শাম্মী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন বাংলাদেশের মিডিয়াতে কাজ করে একসময় পাড়ি জমাই কানাডায়। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে এখানে এসে সেন্টিনিয়াল কলেজ থেকে ব্রডকাস্টিং এন্ড ফিল্মের উপর তিন বছরের এডভান্স ডিপ্লোমা কোর্স করি । কানাডায় পড়াশোনা করতে এসে স্কুলে কখনও কোন বাধা বা প্রতিকূলতা অনুভব করিনি। টিচাররা অনেক আন্তরিক এবং সাপোর্টিভ ছিলেন। এখন আমি এখানে ফিল্মমেকার ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি। ‘আনটায়িং দ্যা নট’ বা ‘শেকল ভাঙার গল্প’ ডকুমেন্টারি পরিচালনার মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে কানাডিয়ান চলচ্চিত্রে আমার অভিষেক হয়। এর আগে এককভাবে স্বল্প দৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছি কিন্তু এককভাবে এটিই আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি।
মূলত এই ছবিটি একদিকে যেমন আমার সুনাম এনে দিয়েছে অন্যদিকে ছবির কাহিনী আমাকে ব্যথিত করেছে রোজ। কারণ এই প্রামাণ্য চিত্রটিতে বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং প্রতিরোধের লড়াইয়ের যে বাস্তবতা তুলে ধরেছি তার মূল ভূমিকায় আছে আমারই বাল্যবন্ধু রুমানা মন্জুর। সাথে এমন আরও তিন নারীর জীবন সংগ্রাম ও লড়াইয়ের গল্পে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘আনটায়িং দ্য নট’ বা শেকল ছেঁড়ার গল্প। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার যে অপসংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটেছে এবং দিন দিন সেটা আরও বাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধানই ‘আনটায়িং দ্য নট’- তৈরির মূল উদ্দেশ্য।
তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মন্জুর স্বামীর নির্যাতনে দৃষ্টিশক্তি হারায়। সে উচ্চ শিক্ষার্থে কানাডায় এসেছিল ২০১১ সালে। তখন একসময় ছুটিতে বাংলাদেশে যায়। এসময়ই তার উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে স্বামীর সাথে মনোমালিন্য তৈরি হয় এবং এর জের ধরে ঘটনাটি ঘটে। তার মুখ ও নাকের কিছু অংশও থেঁতলে গিয়েছিল। ঘটনাটি জানার পর প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার অর্থিক অবস্থা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনটাই এমন ঘটনার সাথে যায়না। অনুভব করলাম নারী নির্যাতনের কোন শ্রেণিভেদ নেই। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর কানাডার ভ্যাংকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (ইউবিসি) রুমানার চিকিৎসার উদ্যোগ নিলে আবার কানাডায় ফিরে আসে রুমানা। তখন তার সাথে দেখা করি এবং রুমানার জীবনের ঘটনাটা সবাইকে জানানোর তাগিদ থেকেই ‘আনটায়িং দ্য নট’ তথ্যচিত্রটি নির্মাণের পরিকল্পনা করি।
২০১৬ সালে আমি ডকুমেন্টারিটি তৈরির কাজে হাত দিই। এ কারণে আমাকে দেশে যেতে হয়েছে কয়েকবার। রুমানার মতো আরও কয়েকজন নারীকে খুঁজছিলাম। পরে আরও তিনজন- শারমীন, নাঈমা ও জেসমিন রাজি হন তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলো জানাতে। তাদের কেউ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার, কেউ যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিয়ের পর পারিবারিক জীবনে সুখী হতে পারেননি তারা, বিভিন্ন ভয়ংকর স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় তাঁদের।
কাজের সাপোর্ট হিসেবে দেশে নারী নির্যাতনের স্বরূপ বের করতে গিয়ে নারীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে দেশের নারী নির্যাতনের যে তথ্য পাই তাতে আমার ধারণা পাল্টাতে থাকে। প্রমাণ পাই নারী নির্যাতনের কোন শ্রেণিভেদ নেই। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চশিক্ষিত নারীদের প্রতি ঘটে যাওয়া নির্যাতনের চিত্রগুলো একইরকম। এমনকি পার্থক্য নেই দেশভেদেও। এটি বুঝতে পারি কানাডার নারী নির্যাতনের বিভিন্ন তথ্য বের করতে গিয়ে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কানাডাতেও দেখা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে পুলিশ, সমাজ সবাই আছে, কিন্তু ওই নারী মুখ খুলতে চান না। আর বাংলাদেশে তো এ চিত্র আরও ভয়াবহ।
২০১৬ সালে জুন মাসে কাজ শেষ হয় ‘আনটায়িং দ্য নট’ বা ‘শিকল ছেঁড়ার গল্প’ এর। ডকু ফিল্মটির প্রোডিউসার ছিলেন ললিতা কৃষ্ণা এবং কেটি সোয়েলস। কানাডার ব্রডকাস্ট চ্যানেল সিবিসিতে প্রিমিয়ার হয় ডকুমেন্টারিটি। এরপর থেকে এর ভাগ্যে একের পর এক যোগ হয়েছে নানা সম্মানজনক পুরস্কার। কানাডা, ভারতের দিল্লিসহ বিভিন্ন জায়গার দর্শকেরা পছন্দ করেছেন। ‘আনটায়িং দ্য নট’ ৭৮ মিনিটের পূর্ণদৈর্ঘ্য তথ্য চিত্র, এটি নির্যাতনের শিকার নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চিত্র। বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনে নিষ্পেষিত হওয়া নারীদের মুক্তি বা সে অবস্থা থেকে উত্তরণের গল্প।
এছাড়াও আমার প্রথম শর্ট ডকুমেন্টারি “স্নেহা” ২০১১ ত টিভি অন্টারিও তে প্রচারিত হয়। ২০১৫ তে আমি গ্লোবাল টেলিভিশনের পুরস্কারপ্রাপ্ত ইনভেস্টিগেটিভ সিরিজ ‘16×9’ এ কাজ করার সুযোগ পাই। যা আমার জন্য ছিল দারুন অভিজ্ঞতা। ভবিষ্যতে নারী নির্যাতন সহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকদিন কাজ করার ইচ্ছা ছিল। কোভিড সময়ে অনলাইনে বসে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কিছু সেশন করেছি সচেতনতা তৈরির জন্য। পাশাপাশি বিষন্নতা নিয়ে একটি ফিল্মের কাজ করছি এখন।
কানাডা’র ডকুমেন্টারি ইন্ডাস্ট্রি খুব ছোট তাই প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। আমাকে সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হচ্ছে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে। কেবল বাংলাদেশের মেয়ে নয়, যে কোন দেশের যে কাউকে ডকুমেন্টারি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য অসম্ভব ধৈর্য এবং পজিটিভ মানিসকতা থাকতে হবে লক্ষ্য ছোঁয়ার। বাধা-বিপত্তি আসবেই, সেটা সামাল দিতে গিয়ে হাল ছেড়ে দেয়া মানে নিজের কাছেই হেরে যাওয়া। তাই আমি বলব ‘ডোন্ট গিভ আপ’।
জানা শাম্মী (বাংলাদেশি- কানাডিয়ান জার্নালিস্ট এন্ড ফিল্মমেকার) টরন্টো, কানাডা