কুলসুম আক্তার সুমী
হাডসনের পাড়ে অবশেষে কমতে শুরু করেছে শীতের প্রকোপ। ঘরবন্দি মানুষগুলো একটু একটু করে বেরিয়ে আসার সুযোগ খুঁজছে। অনেকটা আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হওয়া পত্র-পল্লবহীন গাছের শাখাগুলোতে প্রাণের আভাস ফুটে উঠছে। চেরি জাতীয় গাছগুলো ফুল ফুলে রঙিন। সবুজ ঘাস তার রঙ ফিরে পাচ্ছে ক্রমশ। দূরে তাকালে চোখে-মনে প্রশান্তি এনে দেওয়া সবুজ চোখে পড়ছে।
এখানে গ্রীষ্মকাল সংক্ষিপ্ত। তাই এই সময়কে ঘিরে মানুষের নানা ধরনের পরিকল্পনা থাকে। এখনও যাদের বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে না, তারা একটু আগেভাগেই গ্রীষ্মের আমেজ বা ছুটি কাটানোর চিন্তা ভাবনা শুরু করে দেন। কারণ গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরম, অস্বাভাবিক ভিড় এবং সেই সময়ে পর্যটন স্পটগুলোতে থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের বাড়তি খরচ এড়ানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এবার শীত কমার আগেই হু হু করে বেড়ে গেছে তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমন তার কারণ, ফলে মানুষের মধ্যে গ্রীষ্মের আগমনী উন্মাদনার চেয়ে অস্বস্তিটাই কাজ করছে বেশি।
যুদ্ধ কোনদিনই কারো জন্যই ভাল কিছু বয়ে আনতে পারে না। তবু আমরা দেখি যুগে যুগে, দেশে দেশে নানা কারণে দ্বন্ধ-সংঘাত-যুদ্ধ লেগেই আছে। সবকিছুর পর মানুষই মরছে একথা ভাবার যেন কোথাও কেউ নেই। নারী-শিশু-বৃদ্ধ সবাই মাইনাস টেম্পারেচারে কষ্ট পাচ্ছে, খোলা আকাশের নীচে মানবেতর দিনাতিপাত করছে; এসব দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, পরিবারগুলো ছুটছে, পালাচ্ছে দিগ্বিদিক একটু নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। বাবার থেকে সন্তান, স্বামী থেকে স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। গুটিকতক লোভী মানুষের জন্য অসহায় মানুষগুলো আরো অসহায়, নিঃস্ব হচ্ছে।
আমি টেলিভিশনে সংবাদ দেখা বন্ধ করেছি অনেকদিন। এক অসহনীয় অস্বস্তিবোধ আমাকে গ্রাস করে এসব দেখার পরেই। কিন্তু বর্তমান যুগে চোখ বন্ধ করে রাখার আসলেই কোন উপায় নেই। আমার টিনএজের মেয়ে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেছে, বাবা তার তিন বছরের সন্তান ও স্ত্রীকে গাড়িতে করে দূরে পাঠিয়ে যুদ্ধে চলে যাচ্ছে। ঐ শিশু আর কোনদিন তার বাবাকে দেখবে কিনা সে কথা বলতে বলতে আমার মেয়ের কান্নায় আমি নিজেই কেঁদে ফেলেছি। এসব সংবেদনশীল মানুষের কষ্টগুলো শুধুই ব্যক্তিগত। নীতি নির্ধারকদের কাছে সাধারণ মানুষের এ কষ্টগুলো কখনও স্পর্শ করে না। অথচ তারা নেতা হন জনগনের জন্যই। প্রত্যাশা এসব যুদ্ধবাজ নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, এ যুদ্ধ বিগ্রহের অবসান হবে একদিন।
এপ্রিল মাস এসেছে নানা ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে। সংযমের মাস রমজানের শুরু হয়েছে এপ্রিলের শুরুতেই। এরই মধ্যে ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ, আর সামনে ঈদুল ফিতর। সবাইকে মাহে রমজান ও নববর্ষের শুভেচ্ছা একটু দেরিতে হলেও এবং জানিয়ে রাখি অগ্রিম ঈদ মোবারক। আমরা দেখছি সংযমের মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়েছে কিছু বিতর্ক। রমজান বলা হবে নাকি রামাদান, সেহেরি বলা হবে নাকি সাহুর? এসব আসলে খুব অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক, কারণ সব ভাষারই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব স্বকীয়তা, সমৃদ্ধি বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ইংরেজি ভাষা থেকে আসা ‘টেবল’ কে আমরা বাংলায় ‘টেবিল’ হিসেবে অভিযোজন করে নিয়েছি। সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা লাকসমী শব্দকে বাংলায় ‘লক্ষী’ হিসেবে অভিযোজন করে নিয়েছি। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহারে অভিযোজন বা খাপ খাওয়ানোর বিষয়টা ভাষার নিজস্ব গতিতেই চলে এবং চলতে দেওয়া উচিত।
এপ্রিল আরো একটি কারণে আমার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এটি অটিজম সচেতনতা মাস এবং এপ্রিলের দুই তারিখকে ‘অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। নিজের একটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা থাকার কারণে এ নিয়ে প্রচুর আর্টিকেল পড়েছি, প্রচুর অনুষ্ঠান দেখেছি। জানার চেষ্টা করেছি, করেই যাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা যাদের আছে তারা আশপাশের দুনিয়াকে প্রতিনিয়তই নতুন করে আবিষ্কার করে। সেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন থাকে তেমনি থাকে মধুর অনেক কিছু। কাছের মানুষদের ভেতর উন্মোচিত হয়। এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। তার আগে আরেকটি কথা বলি, অটিজমের লক্ষণগুলোকে তুলনা করা হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে। কিছু ঢেউ আসে, কিছু ঢেউ চলে যায়, নতুন করে আরো কিছু যুক্ত হয়। কোনো সময় হয়তো আপাতঃ শান্ত মনে হয় সমুদ্রবক্ষ, পরক্ষণেই তীব্র উত্তাল। এগুলো আমার কথা নয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন। তাই এদের হ্যান্ডেল করতে হয় বুকভরা ভালোবাসা, অসীম ধৈর্য আর যত্ন দিয়ে।
যা বলছিলাম…. বেশ ক’বছর আগের কথা। আমার বাচ্চার তখন ৪/৫ বছর বয়স। রুজভেল্ট আইল্যান্ডে পরিচিত একজনের বাচ্চার জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছিলো। তখনও আইফোন বা আইপ্যাড এতটা সবার হাতে হাতে পৌঁছেনি। আমি সেই বাচ্চা আর তার বাবা-মায়ের ছবি তুলে দিচ্ছিলাম। আমার বাচ্চা কারো বাচ্চার হাত থেকে আইপ্যাড নিয়ে গিয়েছিলো, জটলার ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, ‘কেমন মা নিজের বাচ্চা সামলাতে পারবে নাতো এরকম বাচ্চা নিয়ে বাইরে আসে কেন? ঘরে থাকলেই পারে।’ ভীষণ খারাপ লেগেছিলো। হাডসনের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে কি কষ্টে সেদিন নিজের দু’চোখের ঢেউ গোপন করেছিলাম শুধু উপরওয়ালাই জানেন। কাউকে কোনদিন বলিনি সেকথা।
ক’দিন পর অন্য কোন পিকনিকে যাওয়ার কথা উঠলো। আমি বললাম, আমি যাবো না। পরিচিত দু’জন ফোন করলো। তাদের বক্তব্য একই রকম, কেন যাবেন না আপনি? বললাম, এমনিই… আমার ভালো লাগছে না। আমার বাবুকে সামলাতে কষ্ট হয়। তারা বললো, যারা ওর কারণে বিরক্ত হয়, আপনি বিব্রতবোধ করেন; আমরা মিশবোনা তাদের সাথে। আমরা আলাদাভাবে থাকবো। আর, এটা কোন কথা হলো, আমরা এতোগুলো মানুষ একজনকে সামলে রাখতে পারবো না! আপনি না গেলে আমরাও যাবো না। শেষ পর্যন্ত গেলাম এবং তারপর থেকে আর কখনো কোন অনুষ্ঠানই এই কারণে মিস করিনি।
আসলে আমার বাচ্চা অন্য কারও সামলানোর প্রয়োজন পড়েনি বা পড়েনা কখনও। ওটা না যাওয়ার জন্য অজুহাত করেছিলাম মাত্র। এখনও আমাদের এমন কিছু সুহৃদ বন্ধু আছে, কোনো অনুষ্ঠানে বা পিকনিকে গেলে আমার বাচ্চার হাত ধরে বলে, আজকের মতো ছেলে আমার। তোরা ঘুরে আয়।
এ তো বাইরের মানুষের আচরণ, নিজের ঘরের মানুষদের কাছ থেকেই কত নিষ্ঠুর আচরণ পেতে হয় একজন স্পেশাল মাকে। আমি একজনকে জানি, নাম পরিচয় না দিয়েই বলি, তার আপন ভাই এবং ভাবী ডাক্তার। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাটিকে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে ভাইয়ের বাসায় গেলে দরজা বন্ধ করে থাকতো, সামনে আসতো না ওর। সে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো মেয়েটা। বলছিলো, এতো কষ্ট ওরা আমায় দিয়েছে, জীবনে ওদের মুখ না দেখলেও খারাপ লাগবে না আমার।
এরকম কত কত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় এক একেকটা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের বাবা-মা বা পরিবারকে, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। তবে, আমি বলবো এসব অভিজ্ঞতাকে দীর্ঘশ্বাস না ভেবে প্রেরণার গল্প ভাবুন। বলা হয়ে থাকে, এসব ক্ষেত্রে মেনে নেওয়ার সময়টাই (এক্সেপ্টেন্স পিরিয়ড) কষ্টের, সীমাহীন কষ্টের। কেন আমার সাথেই এমন হলো? আমি কি এমন করেছি? আমার কি অসচেতনতা ছিলো? এসব প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে এসে একবার যদি মেনে নেয়, যদি ভেবে নেওয়া যায়, যা হয়েছে তা নিয়েই আমাকে চলতে হবে। তাহলে চারপাশের এসব কটু কথা কিংবা আচরণ আর কোন সমস্যা তৈরি করে না। এসব সহ্য করার ক্ষমতা মহান সৃষ্টিকর্তাই দিয়ে দেন। আসলে, আপনার কোন দোষ বা অসচেতনতার কারণে একটি স্পেশাল বেবির জন্ম হয়না। এটা কেন হয় বা হয়েছে তা আজও সঠিকভাবে জানাই যায় নি। সারা দুনিয়ার বড় বড় ডাক্তাররা, গবেষকরা এখনও তা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। সুতরাং একে সহজ আর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিন। এটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়, মানুষই পারে। আপনি পারবেন বলেই আপনার ঘরে এ বাচ্চাটিকে দেওয়া হয়েছে। এসব আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
আমরা যদি একবার ভেবে দেখি, যারা মহাশূণ্য আবিষ্কার করে ফেলেছে, চাঁদে বসত করার পরিকল্পনা করছে, মঙ্গলে যাবার চিন্তা ভাবনা করছে তারাও যে রহস্য ভেদ করতে পারেনি, আপনাকে আপনার প্রভূ তার দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনি সাধারণ (অর্ডিনারি) নন, আপনি বিশেষ (স্পেশাল)। তবে আপনি বিশেষ ছিলেন না, ওর কারণেই আপনি বিশেষ হয়েছেন। এটাও আমার কথা নয়, জ্ঞানী মানুষের কথা। তবে আমার জীবনে তার প্রমাণ পেয়েছি। আমার ধৈর্য খুব কম ছিল, খুব বেশি চঞ্চল ছিলাম। আম্মা বলতেন, “ছেলেমেয়ে বিরক্ত করলেও তো গলা টিপে টিপে মেরে ফেলবে”। সেই আমি কত অবিশ্বাস্য স্থির হয়ে গেছি। এখন মনে হয়, ভাঙার সময় হলে তো ভাঙবোই….জন্মালে মৃত্যু অবধারিত; কিন্তু মচকাবো না সহজে। এখন কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলি, ‘কেটে যায় রক্ত বেরোয় না’। একটুও না।
এপ্রিলের অন্যতম আকর্ষণ টিউলিপ বাগানে গেলাম গতকাল। ৮০ লক্ষ টিউলিপ আছে এই বাগানে। লাল, হলুদ, গোলাপী, কমলা হরেক রঙের টিউলিপের রাজ্যে বিমুগ্ধ, বিহ্বলিত হয়ে কাটালাম কয়েকটা ঘন্টা। হাতের মোবাইলে ছবি তুললাম অগুণতি… কিন্তু একজন ছবি তুললে একজন বাদ পড়ে যাচ্ছে। সেলফিতে কি আর মন ভরে? তাই আমাদেরই মতো ঘুরতে আসা একজনকে বললাম, আমাদের সবার একটা ছবি তুলে দিতে। ফোন হাতে নিয়েই সে ক্লিক…ক্লিক…ক্লিক। তারও ছবি তুলে দিলাম এবং ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালাম।
ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়লো, হুমায়ূন আহমেদের বহু চর্চিত সেই উক্তি, ‘ভালোবাসাবাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, একটি মুহূর্তই যথেষ্ট।’ তেমনি জীবনকে রঙিন, অর্থপূর্ণ ও সুন্দর ভাবার জন্য বা সন্তান সান্নিধ্যে পিতৃত্ব/মাতৃত্বের আবেগে উদ্বেলিত হওয়ার জন্যে ফ্রেমে বাঁধাই করার মতো এরকম একটি মুহূর্তই কি যথেষ্ট নয়? আর সেখানে স্পেশাল বাচ্চা নাকি নিউরো টিপিক্যাল বাচ্চা সে প্রশ্নও বড্ড অমূলক, নয় কি! আসল কথা হলো, জীবন সুন্দর। জীবন যখন যেখানে যেমন তাকে তেমনই যাপন করতে হয়, উপভোগ করতে জানতে হয়।
কুলসুম আক্তার সুমী ( নিউজার্সি) যুক্তরাষ্ট্র