কুলসুম আক্তার সুমী
সেপ্টেম্বর আমার প্রিয় মাস, মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছি বলে। আর এ বছরটা বিশেষ কারণেই বিশেষ… মাতৃত্বের আঠারো বছর পূর্ণ হলো। সময়টা ২০০৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, অনেকটা দূরের সময় কিন্তু চোখ বন্ধ করে এখনো সেই দিনটিকে এইতো কিছুক্ষণ আগের সময় মনে হয়। এতোটা জীবন্ত, এতোটা উদগ্র, এতোটা আকাঙ্খিত, এতোটা কাছের সময় জীবনে খুব কমই থাকে। প্রথম সন্তান অন্যরকম অর্থ বহন করে।
সেদিনটায় বৃষ্টি হচ্ছিলো মুষলধারে। স্বাভাবিক সময়ের সাতদিন পার হয়ে গেছে। আর দেরি করা মোটেই সমীচীন নয়— কিন্তু মা-শাশুড়ি সেকেলে মানুষ, কান্নাকাটি শুরু করেছেন। বলছেন অপারেশন কেন করতে হবে? ভাসুর ফোন করে বলছেন, ব্যথা না উঠলে হাসপাতালে যাচ্ছো কেন? আর অনাগত সন্তানের বাবা ফোন করে বলছেন, আমার সন্তান আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছি ডাক্তার যা বলবে ঠিক তাই করো! কে কি বলছে কিচ্ছু শুনার দরকার নাই। আমার সন্তানের যদি কিছু হয় আমি তোমার কাছেই কেবল কৈফিয়ত চাইবো। কারণ আমি বলেছি কারো কথা শুনার দরকার নাই ডাক্তার ছাড়া।

শেষমেষ ২৪ তারিখ রাতে ঠিক হলো পরদিন সকালে ভর্তি হবো। বাকি সবকিছু ঠিক করাই ছিলো। অপারেশন হলো ঠিক সোয়া তিনটার দিকে। নার্স একটা ছোট্ট পুতুলের মুখ দেখালো আমায়। পুরো জেনারেল হাসপাতালের দোতলা কাঁপিয়ে চিৎকার করছে। আমি একটু তাকিয়েই চোখ বন্ধ করলাম, আমার কিছুটা শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো ততক্ষণে (পুরো অপারেশনে আমাকে অক্সিজেন মাস্ক দিতে হয়নি)। ডা. লেফটেন্যান্ট কর্ণেল অম্বরি বেগম আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুমি সময়মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছো… নইলে তোমার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতো। আমি কেঁপে উঠলাম সর্বশরীরে!
বাচ্চা কোলে দিতে এসেই নার্স বকশিশ চাইবে, আমার ভাবী তাই টাকা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার ওপাশে। ওর কান্না শুনা যাচ্ছে ক্ষুধায়। পেটের মধ্যে পানি শুকিয়ে কত সময় হয়তো খায়নি। তড়িঘড়ি ফিডার আনিয়ে দুধ খাইয়ে ওকে শান্ত করেছেন ভাবী, আমি তার কিছুই জানি না। আমি তখন পোস্ট অপারেটিভ রুমে। তিনদিন পর ওকে নিয়ে বাসায় এলাম। সেই এইটুকু বাচ্চাটা, সেই এক বিঘত দৈর্ঘ্যের পুতুলটা আজ বড় হয়ে গেছে, সত্যিকার প্রাপ্তবয়স (এডাল্ট)। দেখতে দেখতেই দিনগুলো রাত হয়, আবার ভোর হয়, আবার রাত…।

আমাদের আড়ম্বর হয় ভালোবাসায়, স্নেহে, প্রেমে। অন্যকিছুতে বাহ্যিক আড়ম্বর তেমন পছন্দ নয় কারোই। বিশেষ দিনগুলো আমরা নিজেরা উপভোগ করি, কথা বলি, গল্প করি… এইতো! কন্যার আঠারোতম জন্মদিনও তাই আড়ম্বর নয়। আমার বাসার মেহমান ড. মাহবুব মজুমদারের সহধর্মিনী শারমিন হোসেইন একটু অসুস্থ। তাঁর মনে খুব কষ্ট ‘অসুস্থতার কারণে মেয়েটার জন্মদিনের আনন্দটা ভেস্তে গেলো’। রুমে বসেই উনি অর্ডার করলেন কেক। সকাল বেলাতেই কেক এসে গেলো। আগের দিন আমিও কিনে আনলাম ছোট্ট একটা কেক। দুই কেক কেটে দ্বিমিত্রার জন্মদিন পালন হলো। সপরিবারে ড. মাহবুব মজুমদারের সাথে একটা জন্মদিন কাটালো দ্বিমিত্রা এই বা কম কী! স্মরণীয় হয়ে থাকলো দিনটা, সময়টা।
তার আগে আগস্টের শেষদিনে মেয়ে চলে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মেটোরিতে। হঠাৎ মনে হলো, আমাদের বাড়ির আলো নিভে গেলো দপ করে। এতো বড় বাড়িটা শূন্য হয়ে গেলো নিমেষে! কিন্তু সে ভাবনা ভেবে কী হবে? জীবন জীবনের মতোই বয়ে চলে/চলবে। তাই ভেতরে ভেতরে যত কষ্টই হোক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললাম, মা তোর জীবন এবার তুই অনুপম করে গুছিয়ে নে। জীবন বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাক, নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হোক।

তিনদিন পরেই এক বন্ধুর বিবাহবার্ষিকের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে গেলাম মেয়েকে ছাড়াই। পনেরো বছরের আমেরিকা জীবনে আর কখনো তো এমন হয়নি, মেয়েকে ছাড়া যাইনি কোথাও। কিন্তু কিছু করারও নেই, আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে হবে… মেনে নিতে হয়, মেনে নিতে হবে— জীবন যেখানে যেমন।
এক সপ্তাহ পরে মেয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম রাটগার্টস বিশ্ববিদ্যালয়র অনার্স ডর্মে। ওর ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। খুব সুন্দর সুন্দর কিছু মিথ শুনলাম…। যেমন, যে গেটের ছবি দিলাম, ঐ গেট সম্পর্কে বলা আছে রাটগার্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দুবার এই গেটটা দিয়ে যাতায়াত করে। একবার ভর্তির সময় ঢুকে, আর গ্রাজুয়েশন করে বের হয়ে যায়। আজই দ্বিমিত্রা এই গেট দিয়ে ঢুকলো, আর ছবি তুলে দিতে বললো। ছবি তুলে রাখলাম। আমি জানতে চাইলাম, পুরো চার বছরে আর এই গেটটা ব্যবহার করে না!? ও বললো, না অন্যদিক দিয়ে ঘুরে যায়। আমি বললাম, তুই ও কী তাই করবি? ও বললো, করবো।

যে কামানের ছবি দিলাম, ওটা সম্পর্কে মিথ আছে যে, এই কামানটা এক বছর রাটগার্টস ইউনিভার্সিটি চুরি করে আনলে পরের বছর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি চুরি করে নিয়ে যেতো। তাই শেষবার রাটগার্টস ইউনিভার্সিটি ওটা এনে সিমেন্ট দিয়ে এভাবে পাকা করে রেখেছে, যেনো আর নিতে না পারে। আর তারপর থেকে প্রতিবছর গ্রাজুয়েশন করার পর শিক্ষার্থীদের একটি করে কাঠি (স্টিক) দেওয়া হয়, ঐ কামানে আঘাত করে ওটা ভাঙ্গতে হয়। আরেকটা ভবনের সামনে গিয়ে দ্বিমিত্রা বললো, এখানে ভর্তির পর একবার আর গ্রেজুয়েশনের পর আরেকবার ছবি তোলে প্রায় সব ছাত্রছাত্রীরাই। আমি বললাম, বাহ! বেশ মজার তো! ওর ছবিও তুলে দিলাম।
এবার আসা যাক অন্য কথায়। ৪ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক তিনি। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি।বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গান গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা। এ ছাড়া ২০০২ সালে একুশে পদক, ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক, এস এম সুলতান স্মৃতি পদক, একাধিকবার বাচসাস পদকসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়ার পর গাজী মাজহারুল আনোয়ার চিত্রনাট্য, গান, সংলাপ ও কাহিনি রচনা শুরু করেন।

আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা নিজের একটা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা আছে এ কথাটা বলতেও লজ্জা পায়, কুন্ঠিত হয়। হয়তো, সামাজিক নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে বলেই হয়। আমি ওদের দোষ দিচ্ছি না। আমিও যে সে রকম কিছুর মুখামুখি হইনি এমন কিন্তু নয়। কিন্তু ঠেকে ঠেকে আজকের দিনে এসে, মেরুদন্ডটা সোজা করে দাঁড়াতে শিখেছি।
আমি খুব ভালো করে জানি, আমি খুব সামান্য একটা মানুষ। আমি খুব সাধারণ আর সাদামাটা বিষয় নিয়ে লিখি। আমার লেখা পড়ে আহামরি কোন উপকার কারো হয়নি বা হবে না। আমি সমাজ পরিবর্তনের মতো জ্বালাময়ী লেখিয়ে নই… কিন্তু আমার লেখা পড়ে যদি আমার মতো একজন মা ও মনে করে যে সংগ্রাম সে করছে তা আরো অনেকেই করে। যদি নিজেকে একা না ভাবে, যদি মানসিকভাবে এতটুকু শক্তি পায়…। কিংবা যাদের নিজের এরকম বাচ্চা নেই, যাদের আছে তাদের প্রতি এতোটুকু সহানুভূতিশীল হয়, তবে এ লেখা স্বার্থক।

এ মাসে একটা ঐতিহাসিক অর্জন দেখলো বাংলাদেশ। ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে-২০২২ এ বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। অভিনন্দন বাংলার বাঘিনীরা। অভিনন্দন সাবিনা, সানজিদা, মারিয়া, কৃষ্ণা, রুপনা চাকমা, মনিকা, শিউলি,তহুরা সবাইকে। এ অর্জন পুরো বাংলাদেশের। বিজয়ীদের ছাদখোলা অভিবাদনটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবগাঁথা হিসেবে লেখা রবে। এভাবেই এগিয়ে যাক মেয়েরা, এই প্রত্যাশায়…
লাথি মারতে শেখো
লাথি মারতে শেখো মেয়ে…
বুক ভরে অক্সিজেন টেনে নিয়ে
সর্বশক্তি প্রয়োগ করে…।
তোমাকে বলা হয়,
হাত পা গুটিয়ে লাজুক ‘লতা’ হতে,
বলা হয় না তুমি বৃক্ষ হও,
ছায়া দাও,
অবলম্বন হও,
কিন্তু… ঠকে-ঠকে, ঠেকে-ঠেকে
কোথাও তুমিই অবলম্বন হয়ে উঠো।
তখন কোথাও কোথাও কষে চপেটাঘাত ঠিক লাগে!
তোমাকে বলা হয়, আনন্দের উৎস—
সে বলাতে শ্লেষ, করুণা, প্রেম কিছু না কিছু থাকে।
আনন্দের অন্যপিঠে…
একপক্ষ হালকা ঝরঝরে হয়
তুমি হও ভারী।
জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বয়ে বেড়াও চিহ্ন।
অথচ,
সুযোগ পেলে সামগ্রিক আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরি করে দিতে পারো তুমিও,
যেমন আজকে দিলে!
তাই জোরসে লাথি মারতে শেখো মেয়ে…
ফুটবলে,
এবং
আরো অনেক কিছুতে… … … ।
কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র
(২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২)