কুলসুম আক্তার সুমী
আগস্ট শোকের মাস। ১৫ আগস্ট অত্যন্ত শোকার্ত ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। বাঙালির হৃদয়ে শোক আর কষ্টের দীর্ঘশ্বাস হয়ে প্রতি বছরই এ দিন ফিরে আসে। সমগ্র জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করে। ৭৫-এর এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী সদস্য। সেই থেকে ১৫ আগস্ট মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নিদর্শন হয়ে আছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্বাকাশে সূর্য তখনো উঁকি দেয়নি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ঠিক তখনই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ঘৃণ্য ঘাতকের গুলিতে পরিবার-পরিজনসহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঘাতকদের সেই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে বর্বরোচিত ও অমানবিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে স্থান পেয়েছে।
১৫ ও ২১ আগস্ট কোনভাবেই ভুলার মতো নয়। তবু ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে নানা রকমের আনন্দ উৎসব আর উপলক্ষ্য অন্যান্য সময়ের মতো এ মাসেও থাকে। ১ আগস্ট তেমনই এক অনন্য আয়োজনে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য হলো। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলাকে মিস করি সীমাহীন। নিউইয়র্কের ক্ষুদ্র পরিসরের বইমেলা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। বেশ কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম, জীবনের ব্যস্ততায় অনেক বছরের বিচ্ছিন্নতা। অতিমারির কারণে দু’বছর ধরে বইমেলা বন্ধ ছিলো। এবার শুরু থেকেই মনে মনে পণ করেছি যেতেই হবে অন্তত একবার হলেও।
গেলাম ১ আগস্ট রবিবার মেলার শেষদিন। একটা গল্পের চেয়েও সুন্দর বিকেল উপভোগ করলাম। নিউইয়র্ক সাহিত্যাঙ্গনের অনেকের সাথেই ফেসবুকে যোগাযোগ, সামনাসামনি এই প্রথম দেখা। ৯৪ এর ব্যাচমেট ভায়লা সেলিনা লিজার সাথে অনেক দিন থেকেই দেখা হবে হবে করেও হচ্ছিলো না। সেদিনই প্রথম… প্রথম দেখাতে একবারও মনে হয়নি, এই প্রথম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র দিমা নেফারতিতি আপু কে দেখলাম প্রায় বিশ বছর পর। মনে হলো এইতো সেদিন বুঝি ক্যাম্পাসে দেখা হলো, আজ জ্যামাইকা সেন্টার ফর আর্টস এন্ড লার্নিং এ। এক প্লেট থেকে ঝালমুড়ি শেয়ার করে খেলাম ছাত্রজীবনের মতো। ঘাসের উপরে পা ছড়িয়ে বসে গল্পে মেতে উঠলাম কবি আল ইমরান সিদ্দিকিসহ অনেকের সাথে। লিজার পীড়াপীড়িতে কবিতাও পড়ে শোনালাম ফেসবুক লাইভে।
নাজমুন নেছা পিয়ারী আপা ডয়চে ভেলের সাংবাদিক, একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক এতোটা স্নেহে কাছে টেনে নিলেন… সামান্য জীবনে প্রাপ্তির খাতায় যোগ হলো একটা অনন্য স্মৃতি। আদর করে বললেন, বোকা মেয়ে এখানে চুপ করে থাকলে কেউ কিছু জানে না, নিজে থেকেই জানাতে হয়।
লিজি রহমান আপা, শেলী জামান খান আপা, লুৎফুন্নাহার লতা আপা, মাকসুদা আপা, মনিজা আপা একজনকেও মনে হয়নি প্রথম দেখলাম। এতো ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিলো আমার জন্য, আমি তা কুড়িয়ে নিলাম মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু শামীম আল আমিনের সাথে দেখা হয়ে যেনো মেলায় যাওয়ার ষোলকলা পূর্ণ হলো। শামীম ৭১ টিভির রিপোর্টের জন্য বাইট নিলো। এক বিকেলে কত কী! আশা করছি এরপর প্রতিবছর যাবো বইমেলায়। স্মৃতির পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকলো স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর বিকেলটা।
আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ জুড়ে আনন্দ আর আনন্দ ছিলো আমার ঘরজুড়ে, মনজুড়ে। শনিবার মাতা-কন্যা-পুত্র বার্গানমলে গিয়ে শপিং করেছি। একটা পিকনিক পিকনিক আমেজে ছিলাম। দিনশেষে দু’জন বিশেষ অতিথি এসেছে বাসায়। মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডা হলো আমাদের।
রবিবার গেলাম ‘গ্রাউন্ডস ফর স্কাপচার’ এ। ৪২ একর জায়গাজুড়ে ১৯৯২ সালে এই ভাস্কর্য পার্ক গড়ে তোলা হয় নিউজার্সির হ্যামিল্টনে। ২৭০ টিরও বেশি ভাস্কর্য রয়েছে এই পার্কে। রয়েছে মেরিলিন মনরোর ভাস্কর্য এবং ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগের অসংখ্য ছবি।
এতো সুন্দর একটা জায়গা যতই দেখি দেখার যেনো শেষ হয় না। চমৎকার রোদের দিন ছিলো। হাঁটতে হাঁটতে একটু ক্লান্তি বা জলতেষ্টা পেয়েছে বটে, তবে এই সৌন্দর্যের কাছে সে কষ্ট খুবই সামান্য।
এতো সুন্দর পদ্মবিল, শাপলা বিল(কৃত্রিমভাবে করা), রঙিন মাছের আবাস, সবুজ প্রকৃতি আর বিখ্যাত সব ভাস্কর্য অসংখ্য বেহিসেবি প্রহর কাটিয়ে দেওয়া যায় এগুলোর দিকে তাকিয়ে।
আমরাও ছিলাম প্রায় দুই ঘন্টার বেশি সময়। পুত্র আর তার পিতা কিঞ্চিত বিরক্ত হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের মাতা-কন্যার মোটেই অস্বস্তি হয়নি। আমাদের কাছে এইসব জীবনের অমূল্য সময়, অমূল্য দেখা। কত কী যে দেখার আছে, শেখার আছে !
আগস্ট মাসেই আমার আরেক ভালোলাগার, ভালোবাসার বিষয় বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস। কিছু বুঝার বয়স হওয়ার আগেই আমি প্রকৃতির প্রেমে পড়েছি। গাছপালা, লতাপাতা, ফুল-পাখি সবকিছুর দিকেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। সে বিস্ময় আমার এখনো আছে, কখনোই বোধহয় কাটবে না। আম্মা বিরক্ত হয়ে বলতেন, এলাচ মোড়ার তলে আর বকুল গাছের তলে ওরে কেউ তাবিজ করছে। (এখন বুঝি, এলাচের পাতা, ফুল আর তিন/চারটা পাতা মুড়িয়ে টুনটুনির বাসায় ছানাদের কিচিরমিচির আর বকুলের ঘ্রাণ সত্যিই আমাকে তাবিজ করেছিলো। আর সে তাবিজের প্রভাব এখনো স্বমহিমায় বিদ্যমান।)
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফটোগ্রাফি আমার একটা বিষয় ছিলো। জীবনে খুব কম বিষয়ই মন থেকে ভালোবেসে পছন্দ করেছি, তার মধ্যে ফটোগ্রাফি একটি। আমাদের দেশে ইচ্ছার দাম থাকেনা, যে বিষয়ে সুযোগ পায় এবং ভবিষ্যতে ভালো সুযোগ আছে তাই পড়তে হয়।
ছবি তোলা আমাকে আনন্দ দেয়, আমার বিস্ময়ভরা চোখের দেখাকে আরো মহিমান্বিত করে, আবার দেখার সুযোগ করে দেয়। আমি তাই যেখানেই যাই অনেক ছবি তুলি। আর যখনই তুলি ফেসবুকে পোস্ট করি, আমার চোখ দিয়ে বন্ধুদের দেখাই।
একজন বিশিষ্ট গণিতবিদ ও পদার্থবিদ সপরিবারে আমার বাসায় আছেন দুই সপ্তাহ ধরে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ডেটা আন্ড সায়েন্সেস-এর ডিন ও অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডের অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. মাহবুব আলম মজুমদার, উনার স্ত্রী শারমিন হোসেইন ও ছেলে মিখাইল মজুমদার।
মিখাইলের মামা কাল দুপুরে ফিলিপিনো (আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে বাবা ড. মাহবুব হোসেইনের কাজের সুবাদে শারমিনদের বেড়ে উঠা ফিলিপাইনে) দোকান থেকে কেক অর্ডার করে পাঠিয়েছেন, কোন কারণ ছাড়াই। আমরা সে কেক কেটে আনন্দ উদযাপন করলাম। আমার প্রতিদিনই আনন্দময় দিন। আমরা প্রায় প্রতি বিকেলে খেলার মাঠে যাচ্ছি, হাঁটছি। প্রতি সন্ধ্যায় ঘরোয়া আড্ডায় মেতে উঠছি।
ড. মাহবুব মজুমদারের কথা লিখতে গেলে একটা নয় দু’দশটা বই লিখা যাবে। সে চেষ্টা আমি করবো না, ততোটা যোগ্যতা আমার হয়নি, কখনো হবেও না।
১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া এ মানুষটা বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। হাইস্কুল পর্যায়ে দু’দুবার হয়েছেন সেরা ছাত্র। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের হাত থেকে নিয়েছেন পুরস্কার। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে স্নাতক ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। পিএইচডি করেছেন বিশ্বসেরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স ও থিওরেটিকাল ফিজিক্স (DAMPTP)-এ। ক্যামব্রিজে তাঁর অফিস কক্ষের খুব কাছেই ছিলো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের অফিসকক্ষ। স্টিফেন হকিং তার বইতে লিখেছিলেন তার কিছু প্রিয় সহকর্মী ও শিক্ষার্থীর কথা। সেই মেধাবীদের তালিকায় অন্যতম ছিলো মাহবুব মজুমদারের নাম।
ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও কৃতিত্ব নিয়ে তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ২০০৫ এ দেশে ফেরার পর থেকেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের জাতীয় কোচ হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তার নিরলস পরিশ্রম ও অভিনব প্রশিক্ষণের ফলে এই ক’বছরে বাংলাদেশের ঝুলিতে এসেছে বেশকিছু ব্রোঞ্জ, রৌপ্য ও একটি স্বর্ণপদক।
এই এতো এতো এতো গুণের আর প্রতিভার মানুষটা আমায় বলে, আমাকে তুমি বলেন। আপনি না আন্টি হন… আমি আকাশ থেকে পড়ি। মানুষটার নখের সমান যোগ্যতাও আমার নাই, আমায় এমন সম্মান করে কথা বলে। একটা সময় সারা আমেরিকায় রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদারের ছেলে মাহবুব মজুমদার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছে, সে সংবাদ বড়ভাইদের মুখে শুনে কত ভেবেছিলাম… আহা! মানুষটাকে যদি একবার চোখে দেখতাম? আজ সে আমার অতিথি! ভাবতেই চমক লাগে।
তাঁর ভেতরে খুব ছোট শিশুর মতো একটা মন আছে। শিশুদের মতোই কোমল তার আচরণ, কথা বলে খুব আস্তে। হাঁটার সময় পায়ের আওয়াজও পাওয়া যায় না। মানুষ বড় (জ্ঞানী) হলেই বোধহয় এতো বেশি ছোট (শিশু) থাকতে পারে।
আমরা শিশুসুলভ গল্পে মেতে উঠি। শিশুর মতোই হেসে উঠি। আর মনে মনে প্রার্থনা করি… আনন্দদিনগুলো দীর্ঘায়িত হোক।
২৫ আগস্ট ভাতিজা আমার কাছে এসে আবার চলেও গেছে ২৮ তারিখে। গ্রীষ্মের ছুটির একদম শেষদিকে বন্ধুর কাছে বেড়াতে গিয়েছিলো কানাডা। সেখান থেকে ফিরার পথে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
আগেরদিন কল করে বলেছে লইট্টা মাছ খাবো। সাফায়েত মজুমদার পেটারসন গিয়ে লইট্টা, ইলিশ, রূপচান্দা আর ছোটমাছ এনেছে। সাথে পাটশাক। স্পন্জ মিষ্টি, দধি যা খেতে চেয়েছে সব এনেছে। এই একটা ব্যাপারে মানুষটার তুলনা হয় না, একবার বলেছে (ছেলে-মেয়ে, বউ আশপাশের কেউ) এই জিনিস খাবো, যে করেই হোক যত কষ্টই হোক এনে সামনে হাজির করবেই সাধ্যে থাকলে। তিন রকমের মাছ ভাজি আর পাটশাক দিয়ে মজা মজা করে ভাত খেয়েছে কতদিন পর।
এই তিনদিনেরই একটা রাতে জম্পেস আড্ডা হলো ড. মাহবুব মজুমদারের সাথে। জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরো একটা গল্প করার মতো রাত জমা হলো। আমার কাছে জীবন সুন্দর। আসা-যাওয়ার সুখ কিংবা কষ্ট ছাপিয়ে আমি প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করি জীবনকে। জীবন যখন যেখানে যেমন তেমনই সুন্দর ও আনন্দের।
কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র
(২৮ আগস্ট, ২০২২)