কুলসুম আক্তার সুমী
শীত প্রধান এদেশে জুন আসে গ্রীষ্মের আনন্দ আর শিক্ষাবর্ষ শেষের ব্যস্ততা নিয়ে। সারা বছরের ব্যস্ততার সাথে এ সময় যোগ হয় গ্রাজুয়েশন পার্টিতে যাওয়া, ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন স্কুলের ওরিয়েন্টেশনে যোগ দেওয়া, পিকনিক, বিচে যাওয়া ইত্যাদি। আমার জন্য এ বছরের এ সময়টা অন্যরকম ব্যস্ততার এবং আনন্দের। ছেলের ক্লাস এইটের গ্রাজুয়েশন হলো, ক্লাস নাইনে যাবে সে নতুন স্কুলে। মেয়ের হলো টুয়েলভ গ্রেডের, সে যাবে কলেজে। সবকিছু মিলে কেটে যাচ্ছে ছুটে চলা জীবন।
প্রতিমাসেই লিখার সময় ভাবি এবার তো খুব ভালো কিছু হলো না, পরের মাসে খুব মনোযোগ দিয়ে লিখবো। এ সময় ব্যস্ততা এবং শারিরীক, মানসিক ক্লান্তি আরো জেঁকে বসেছে; ভাবছিলাম এ মাসে লিখবো না। হুড়োহুড়ি করে কোনরকম লিখতে ভালো লাগে না, পরে মনে হলো প্রতিমাসেই আমার ব্যস্ততা থাকবে। সময় নিয়ে ভালোভাবে লিখবো বা করবো ভাবলে আমার কোনকিছুই করা হবে না। তারচেয়ে অন্তত ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখি।

গ্রীষ্মের এই সময়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর পিকনিক প্রবাসে একটা অন্যরকম উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। সারা বছর শীতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো একে অন্যের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। এ মাসের উনিশ তারিখে আমার এলাকার পিকনিক ছিলো। কুমিল্লা জেলার বৃহত্তর লাকসামের এই পিকনিকে শত শত মানুষ একত্রিত হয়েছিলো। এ এক অন্যরকম আনন্দের মিলনমেলা। কারণ ব্যস্ততার জীবনে সবার সাথে আলাদা করে দেখা সাক্ষাত খুব সহজসাধ্য নয়। তাছাড়া অতিমারি পর্রবর্তী সময়ে, মাস্ক খুলে কাছে আসার এ সময়টার জন্য যেন এলাকার মানুষগুলো হাসফাঁস করছিলো এতোদিন। গান- বাজনা, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা আনন্দে কখন যে একটা দিন কেটে গেলো টেরই পেলাম না।
যখন রোকেয়ানামায় লিখবো মনস্থির করেছিলাম, ভেবেছিলাম, কেবলই নিজের রোজকার ভালোমন্দ, চিন্তা ভাবনা এসব নিয়েই লিখবো। কিন্তু লিখতে বসে আশপাশ বা বাইরের দুনিয়াই ঘুরেফিরে চলে আসে। আসলে মানুষ তো সমাজবদ্ধ জীব। চারপাশকে বাদ দিলে আমি আর থাকি কোথায়?

গতকাল ছিল বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের দিন। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মাসেতুর উদ্বোধন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতুর মূল দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দু’পাশে সংযোগকারী রাস্তা রয়েছে ১৪ কিলোমটার। পদ্মাসেতুর প্রস্থ ৭২ ফুট। এতে আছে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার। সেতুটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে যুক্ত করেছে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তকে। নদীতে যাতে বড় লঞ্চ চলাচলে সমস্যা না হয় সেজন্য পানি থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে করা হয়েছে এই সেতু। এতে মোট পিলার আছে ৪২টি এবং পাইলিং আছে ২৮৬টি।
পদ্মা সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়। এটি আমাদের অহঙ্কার, আমাদের সাহসিকতা, আমাদের সক্ষমতা, আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মিত হয়েছে এটি আমাদের আরেক বিজয়, আমাদের গর্ব। এ আনন্দ ভীনদেশে বসেও আমাদের সমানভাবে আনন্দ দিচ্ছে। পদ্মাসেতু নির্মাণের সাথে জড়িত প্রতিটি শ্রমিক, কলাকৌশলী সবাইকে সশ্রদ্ধ সালাম। সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন।

দু’দিন আগে ভোরবেলা আফগানিস্তানের ঘন জনবসতিপূর্ণ খোস্ত শহরের কাছাকাছিতে আঘাত হানে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্প। সহস্রাধিক মানুষ মারা যায় প্রথম ধাক্কাতেই, আহত দেড় সহস্রাধিক। এটি সরকারি হিসেব, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলেই অনেকের ধারনা। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বাড়তে পারে। খাদ্যাভাব এবং রোগ বিস্তার বিশেষ করে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিবে বলে আশংকা করছে জাতিসংঘ। মানবসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে নাকাল দেশটির মানুষের দিকে তাকালে বারবারই কেবল মনে হয় ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কোথায়?
জুন মাসে সমবয়সী বেশ কিছু বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু শারিরীকভাবে ক্লান্ত আর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে রেখেছে। এদের বেশিরভাগই আপাতঃ সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলো। এই মৃত্যুগুলো ‘অতিমারি পরবর্তী মানসিক ট্রমা’ কী না এই প্রশ্নটা বারবার আমার মনে এসেছে। রিমা, সোহরাওয়ার্দী, পার্থ, স্বপ্না এই নামগুলো জানা; মানুষগুলো নয়। এদের বাইরে আরো কত কত জন হারিয়ে গেছে তাদের নামগুলোও জানি না।

অন্তর্জালের কিছু পোস্ট, গান, কবিতা ছবি দেখে দেখেই এদের যৎসামান্য চেনা। চলে যাবার আগে হয়তো কখনো মনেও হয়নি এদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার কথা। এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবার পরই মনে হতে লাগলো এরা কি তবে খুব বেশি একা ছিলো, নিঃসঙ্গ! এসব ভাবনা এখন আর তাদের কোন কাজেই আসবে না, যারা চলে গেছে জীবনের সীমা ছাড়িয়ে… কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের কাজে আসতে পারে। তাই বন্ধুদের বলবো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হাজার হাজার বন্ধুর খবর একজনের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যারা পূর্ব পরিচিত বা খুব ঘনিষ্ট তারা কেবল লাইক কমেন্টের বন্ধুত্ব রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তার বাইরে গিয়ে মানসিক কষ্টের সময় পাশে দাঁড়াও সাপোর্ট দেওয়ার মতো বন্ধু হও।
বিষণ্ণতা এমন একটা মানসিক ব্যাধি যা যে কোন শিক্ষা, যোগ্যতা বা পদমর্যাদার মানুষেরই হতে পারে। যদি কেউ একাকীত্ব অনুভব করো, যদি কেউ ভেতরে ভাঙন টের পাও… কথা বলো বন্ধু। নিজেকে প্রকাশ করো। জীবনের চেয়ে সুন্দর, জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই, কিছুই নেই।

আমি বরাবরই আশাবাদী মানুষ। যে মানুষগুলো/ যে বন্ধুরা আমাদের ছেড়ে গেছে তাদের রূহের মাগফেরাত কামনা করি। আর যারা বেঁচে আছে তাদের জন্য ভালোবাসা। সকল অভাব, অপ্রাপ্তি, অসুবিধার পরও জীবন সুন্দর, জীবন উপভোগের জন্য। জীবনকে উপভোগ করো যখন যেখানে যা কিছু আছে তা দিয়েই। হতাশা বা বিষণ্ণতা প্রকাশ করার মতো অন্তত একজন বন্ধু খুঁজে নাও।
আমায় যদি বন্ধু ভাবো,
বলতে পারো প্রাণ উজাড় করে…
তোমার নিরব বেদনা, বিষণ্ণতা
আর কষ্টের গল্প।
কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি (যুক্তরাষ্ট্র)