0

জীবন যেখানে যেমন  ( পর্ব-৩)

Share

কুলসুম আক্তার সুমী

আমি হাডসন তীরের একটা ছোট্ট শহরের বাসিন্দা। এটাকে শহর না বলে মফস্বলও বলা যেতে পারে। ম্যানহাটন শহরের অদূরের একটা শহরতলী। যা হোক… অবশেষে পুরোপুরি গ্রীষ্মের আমেজ এসেছে এখানে। হাডসনের জলে গলে গলে পড়ছে যেন দু’তীরের সবুজ। এ সময় এ শহরটা সবুজে মোড়ানো থাকে। তার সাথে পথে পথে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল।

 যতদূর দৃষ্টিসীমায় আসে অপূর্ব সবুজ আর নানা বর্ণের ফুলের সমাহার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। পথে ঘাটে, ঘাসের উপরে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায় হরেক রকমের পাখি। কাঠবিড়ালি দেখা যায় সারা বছরই, এ সময় আরো বেশি। হরিণের পাল আসে মাঝে মাঝে বেড়াতে, ঘাস খেতে। 

জুনের মাঝামাঝি থেকে মরুভূমির লু হাওয়ার মতো গরমের বাড়াবাড়ির কারণে বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাই ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখার এখনই সময়। আর আমার সাধ্যের মধ্যে, সীমিত পরিসরে সে কাজটা আমি সবসময়ই করি। 

আগের লেখায় বলেছিলাম, এবার গ্রীষ্মের আগমনের সাথে সাথে তেল, গ্যাস এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনমনে অস্বস্তি নিয়ে এসেছে। সময় যত গড়াচ্ছে সে অস্বস্তি কমার বদলে ক্রমেই আরো বাড়ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তেল-টোল-নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে সব সময় এবং সবখানেই; কিন্তু সেটা বাড়ে খুব ধীরলয়ে। এই দাম বৃদ্ধিটাকে এখানে স্বাভাবিকভাবেই নেয় মানুষ। 

আর এদেশে কৃষি ও ডেইরি পণ্যের দাম বাজারের অন্যান্য জিনিসের আনুপাতিক হারে কমই থাকে। কারণ এসব খাতে সরকার প্রচুর ভর্তুকি দেয়া হয়। তবে এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। হঠাৎ করেই বেড়েছে কৃষি, ডেইরি সহ সব ধরনের পণ্যের দাম। যেমন, ডিমের দাম পাঁচ ডলার থেকে হয়েছে দশ ডলার, দুধ তিন ডলার থেকে পাঁচ ডলার। যা নিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলতে শুরু করেছে বেশ জোরেশোরেই। 

অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের সংকট কখনো সখনো নানা কারণেই হতে পারে, হয়। যেমন জাহাজ জট, পণ্য খালাসের সমস্যা বা রপ্তানিকারক দেশের সাথে কূটনৈতিক টানাপোড়েন। কিন্তু এবার শিশুখাদ্য ফর্মুলার দীর্ঘায়িত সংকট জনমনে অনেক বেশি অস্বস্তি তৈরি করেছে। 

যাদের এই পণ্যের প্রয়োজন নেই মানে যাদের ঘরে ছোট বাচ্চা নেই তারা হয়তো এর প্রভাব বুঝতে পারবে না—কিন্তু একজন মা যখন চল্লিশ মাইল গাড়ি চালিয়ে গিয়ে বাচ্চার দুধ কিনতে না পেরে ফিরে আসে; একজন নারী হিসেবে, একজন মা হিসেবে সে কষ্ট, সে অস্বস্তি, সে আতঙ্ক আমাকে ছুঁয়ে যায়, আমি অনুভব করি। 

বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মধ্যে যে অসহিষ্ণুতা চরম আকার  ধারণ করছে, এসব কারণও দায়ী তার জন্য। নিউইয়র্কসহ অনেক রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে হত্যা সহ নানা রকম সহিংসতা বেড়েছে সাবওয়ে সহ সব জায়গায়।

গত এক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম ঘটনা ঘটেছে গতকাল টেক্সাসের একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বন্দুকধারীদের গুলিতে একজন শিক্ষক সহ এখন পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছে আরো অনেক শিশু। এ নিয়ে এখানকার জনগণের মাঝে সীমাহীন আতঙ্ক কাজ করছে।

শুধু টেক্সাস নয়, সারাদেশের মানুষ বাচ্চাদের স্কুলে দিতে ভয় পাচ্ছে। স্কুলগুলোতে প্রহরীদের সতর্ক রাখা হয়েছে। “সকালে যে বাচ্চা স্কুলে দিয়ে বাবা-মা কাজে গেলেন, তাঁরা আর দেখতে পাবেনা তাদের সন্তানদের। এই ভয়াবহতা, এই কষ্ট পৃথিবীর আর কোন কষ্টের সাথে তুলনা হয়না”। এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সিএনএন এর একজন সাংবাদিক।

 গেলো সপ্তাহে নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে বন্দুকধারীর গুলিতে দশজন নিহত হওয়ার পরেই টেক্সাস ও শিকাগোতে একই রকমের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। গতমাসে একই রকমের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মিনেসোটা ও পেনসিলভানিয়ায়। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত বাফেলো শহরে বন্দুক হামলার পর থেকে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে সেখানকার  প্রবাসীরা।  

অতিমারি করোনার আতঙ্ক সামান্য মিইয়ে আসলেও পুরোপুরি কাটে নি। প্রায় দেড় বছরের পাঠ কার্যক্রম অনলাইনে  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার পর স্কুল খুলেছে। অবস্থার কিছু উন্নতি হওয়ার পর মাস্ক ব্যবহারের উপর থেকে কড়াকড়িও শিথিল করা হয়েছে। 

তবে, প্রতিষ্ঠানিকভাবে শিথিলতা থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকেই মাস্ক ব্যবহার ও বারবার হাত ধোয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে রোগী শনাক্তের হার আরেক দফা বেড়ে যাওয়ায় স্কুলগুলোতে মাস্ক আবশ্যকীয় (ম্যান্ডেটরি) করার বিষয়টি শিক্ষা বোর্ডগুলো সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। 

এদিকে জনসাধারণের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরেক ভাইরাস মাঙ্কিপক্সের আতঙ্ক। যদিও এটি কোভিডের মতো অতিমারি হবে না বলেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা; তথাপি এর চরিত্র বদল চিন্তিত করছে তাঁদেরকে, আর সে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে। ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক ও ফ্লোরিডায় শনাক্ত হয়েছে দু’জন। তাদেরকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। জনগনকে সতর্ক করে সংবাদ প্রচার করছে গণমাধ্যমগুলো। 

নতুন, পুরাতন আতঙ্ক ছাপিয়ে পার্ক, বিচ ও পর্যটন স্পটগুলোতে এ সময় বিশেষ করে সপ্তাহান্তের ছুটিতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। বছরের তিন চতুর্থাংশ সময় ঠান্ডায় নিমজ্জিত এ অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল আসেই উৎসবের আমেজ নিয়ে। আবদ্ধ ঘরের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় খাওয়া, বারবিকিউ, সূর্যস্নানের মতো অনেককিছুর সুযোগ নিয়ে। 

এদেশীয়রা সে সুযোগ কাজে লাগায়, ভাবনাহীন জীবনে বেরিয়ে পড়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য। অর্থ, সময়, পিছুটান নানাবিধ কারণে আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না সেরকম করে বেরিয়ে পড়া। তবে সাধ্য মতো আমরাও চেষ্টা করি কাছে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে। খুব দূরে না হোক, ‘ঘর হইতে মাত্র দুই পা ফেলিয়া’ কাছে ধারের সৌন্দর্য অবলোকনের চেষ্টা থাকে আমাদেরও। 

যেখানে যে সুন্দর চোখে পড়ে তাকেই তুলে আনি ছবি করে। ফেসবুকে শেয়ার করি, বন্ধুদের দেখাই। কেউ কেউ খুশি মনে সে আনন্দের ভাগ নেয়। কেউ কেউ বলে, লতা-পাতা, ফুল-পাখি, খেলনা-দোলনা যেখানেই যা পায় তা ই ফেসবুকে দেখানোর এমন কি আছে? 

সকল অভাব, অপ্রাপ্তি, অসুবিধার পরও আমার কাছে জীবন সুন্দর, জীবন উপভোগের জন্য। আমার নিজস্ব অভিমত, সৌন্দর্য ও আনন্দ যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া উচিত, লুকিয়ে না রেখে। আর জীবনকে উপভোগ করতে হয়, অতিবাহিত না করে যাপন করতে হয়; যখন যেখানে যেমনটা আছে তা দিয়েই। 

কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি (যুক্তরাষ্ট্র)