0

কষ্টের সময়ের রসদ যোগান দিতেই কিছু সুন্দর সময় আসে

Share

জীবন যেখানে যেমন (পর্ব-১০)

কুলসুম আক্তার সুমী

দেখতে দেখতে বছরটা শেষ হয়ে গেল, আর মাত্র ক’টা দিন পরেই নতুন বছরের শুরু, ২০২৩। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় এইতো সেদিন বন্ধু ফারাহ জাবীন শাম্মী ফোন করে বলল, একটা নতুন কাজ করতে চাই। বিশেষতঃ মেয়েদের জন্য একটা অনলাইন ফ্লাটফর্ম করতে চাই। সাথে থাকবে তো, একটা নাম চিন্তা করেছি মতামত দাও। বললাম, এরকম মহৎ কাজে থাকতে পারলে নিজেকে রীতিমত অভিনন্দন জানাব। আমি আছি শুরু থেকেই আছি, আর নামটাও পছন্দ হয়েছে। শুরু করে দাও, ভিডিও বানিয়ে শুভাশীষও জানালাম জীবনে এই প্রথম। 

যদিও সেই পোর্টাল নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে আলোর মুখ দেখতে দেখতে বছরের প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গিয়েছিল। তথাপি চোখের পলকে এখন প্রায় একটা বছরই অতিবাহিত করে ফেলল। ২০২৩ এর শুভ নববর্ষ ও শুভকামনা প্রিয় ‘রোকেয়ানামা’। 

বছরের শেষ মাসটায় দারুন কিছু সুসংবাদ পেয়েছি। ঢাকায় ভাতিজির বিয়ে হয়েছে ডিসেম্বরের দুই তারিখে। বিয়ের আসর থেকেই বড় জামাই ভিডিও কলে নতুন বর কনেকে দেখাল। আমি একটা ছবি তুললাম সেই কলে থেকে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটা কবিতা লিখে সেই ছবি পোস্ট করলাম। খানিক পরেই সে পোস্টে মন্তব্য করল ৯৪’র এক বন্ধু। জানতে চাইল, কনে তোমার কি হয়? বর তো আমার চাচাতো ভাই। পরে ওকে ফোনে বললাম, তোমার সাথে তো আমার সম্পর্ক বদলে গেল, তুমি আমার ভাতিজির ননাস, সুতরাং আমার খালা। ও পাল্টা জবাব দিল, নতুন সম্পর্ক চির নতুন, সুন্দর আর মুগ্ধতায় ঘেরা থাক, আমরা বন্ধু আমাদের মত থাকি। সে দোয়াই রইল নব দম্পতির প্রতি… যুগল জীবন নব আনন্দে উদ্ভাসিত হোক, হোক সম্ভাবনাময় সুখের। 

এর মাঝে ক’টা দিন এক অন্যরকম আনন্দ আর উত্তেজনায় কাটল। সাত বছর আগে প্রথম ভাতিজির বিয়ের সময় ঠিক একই রকম আনন্দে কেটেছিল। দ্বিতীয় ভাতিজির বিয়ে দেশে একরকম হঠাৎই, আমার যাবার উপায় নেই। শুনা আর দূর থেকে প্রাণভরে দোয়া করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। 

কিন্তু সেই একই সময়ে একই দিনে কাছাকাছির দেশিয় এক পরিবার— যাদের সাথে নিত্যদিনের উঠাবসা, যে মেয়েটা (মাইশা) চোখের সামনে দিয়ে বেড়ে উঠল এখন তারও বিয়ে। ভাতিজির বিয়ের আনন্দ করতে পারিনি তাতে কী! আনন্দ ঠিক এসে হাজির আমার দ্বারে। 

নভেম্বরের শেষদিন সন্ধ্যায় মাইশা ইনবক্সে শাড়ির ছবি পাঠিয়ে লিখল, ব্লাউজ-পেটিকোট নিয়ে আসবেন দুই ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। আমি লিখলাম… বাহ লাল শাড়ি তো খুব সুন্দর হয়েছে। ও রিপ্লাই করল, আন্টি স্পেশালি আপনার কথা ভেবে কিনেছি। আমি বললাম, শুনে খুব খুশি লাগছে আম্মা, শুধু চিন্তা করছি ব্লাউজের রঙ মিলবে কি না? 

কিছু সময় পর ওর মায়ের ফোন, বললেন দ্বিমিত্রা কি আসবে? শাড়ি তো সীমিত কেনা হয়েছে। বললাম, মেয়েটার পড়ার চাপ বলল, গত সপ্তাহে থ্যাঙ্কগিভিংয়ের ছুটির সময়। ভাবী মন খারাপ করলেন কিছুটা। মেয়েকে ফোন করলাম, বললাম মাইশার বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল না, শুধু আকদ হবে এমনই কথা ছিল এতদিন। এখন সব অনুষ্ঠানই হচ্ছে, তুই কি আসতে পারবি বাবা? মেয়ে বলল, একটু কষ্ট হয়ে যাবে প্রজেক্টের কাজ করতে তবে আসতে ইচ্ছা করছে আম্মু। 

আবার ফোন করলাম ভাবীকে, শাড়ি দু’টো রাখতে হবে আমার কন্যা আসবে বিয়েতে। ফোনে থাকতেই শুনতে পেলাম আওয়াজ একজন এসেছেন শাড়ি নিয়ে যেতে। ভাবী বললেন আপনিও আসেন শাড়ি নিয়ে যান আর হলুদের স্টেজটা করে দিয়ে যান। গেলাম স্টেজ সাজালাম আমি ও অন্যরা মিলে। শাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরলাম দশটার পর। 

পরদিন বৃহস্পতিবার আবার স্বপ্ন ভাইয়ের (মাইশার আব্বা) ফোন, ভাবী মেয়ে আরো ক’টা ফুল কিনে এনেছে। বলছে, আন্টি আসলে ভালো হত। ফুলগুলো কোথায় কিভাবে লাগাব আন্টি সুন্দর করে পারে। বললাম, ঠিক আছে আমি ছেলেকে নিয়ে তায়কোয়ান্দো ক্লাসে এসেছি, আপনি আসেন। আমি যাব ঠিক করে দিব ফুল, লাইট সবকিছু। সেদিনও ফিরলাম সাড়ে দশটায়। 

পরদিন শুক্রবার মজুমদার ভোর থেকে দশটা পর্যন্ত কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েকে এনে আবার বিকেলে গেল কাজে। আমি কাজ থেকে ফিরে বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম বিয়েবাড়ি। শাড়ি, চুড়ি সবকিছু নিয়ে গেলাম কারণ প্রচন্ড শীত ওখানে গিয়েই পরব শাড়ি। যাওয়ার আগেই অবশ্য জানি সন্ধ্যায়ই পড়ানো হবে বিয়ে কারণ পরদিন মসজিদে বিয়ে পড়ানো যাবে না, মসজিদ কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স নেই। যাই হোক বিয়ে পড়ানো পর্ব শেষ হল। 

হলুদের শাড়ি পরনো শুরু করলাম। এই আনাড়ি হাতেই পাঁচজনকে শাড়ি পরালাম তারমধ্যে মাইশার গায়ানিজ বান্ধবীও আছে। এরপর নিজে পরলাম। মজুমদার কাজ শেষ করে গেল, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই মিলে আনন্দ করলাম আমরা। মজুমদার ছেলেকে নিয়ে আগেই ফিরল বাসায় ভোর ছ’টায় আবার তার কাজ। আমরা মা-মেয়ে ফিরলাম রাত বারটায়। 

শনিবার বিয়ের অনুষ্ঠান টিনেক দারুল ইসলাহ মসজিদে। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে সালাদ কাটার। স্বপন ভাই সব উপকরণ দিয়ে গেলেন আমি তিন ট্রে সালাদ কেটে দিলাম, কন্যা ট্রেতে সাজাল। মজুমদার একবেলা কাজ করে এল। সালাদের ট্রে দিয়ে আসল মসজিদে। আমরা রেডি হলাম গেলাম বিয়ে খেতে। মজার বিষয় হল, আমাদের কন্যা গেইটে বরযাত্রীদের গেইট আটকানোর দলে ছিল, অনেক মজা করেছে। বরযাত্রীদের দেওয়া টাকা তাঁদেরই মুরুব্বি কেউ একজন সবার মধ্যে ভাগ করে দিলেন। আমাদের কন্যাও একশ ডলার ভাগ পেল। আনন্দই আনন্দ। ডলার নয় আমাদের কন্যা ওখানে গিয়ে আনন্দ করেছে এটাই অনেক বড় পাওয়া।

সাড়ে আটটায় বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝপথে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। কন্যাবিদায় পর্যন্ত থাকা হল না। বাসায় ফিরে শুধু জামাকাপড় পরিবর্তন করেই দ্বিমিত্রাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরলাম রাত সাড়ে এগারটায়। সকাল ছ’টায় মজুমদারের কাজে, আমার শুরু করলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান। পরদিন থেকে শুরু যথারীতি জীবনের রুটিন যুদ্ধ। 

জীবন চলমান, জীবন এমনি করেই চলতে থাকে, থাকবে। মাইশাকে হলুদের শাড়ি পরিয়ে দিলাম, দ্বিমিত্রাকে, আদিলাকেও। এরা সবাই আমার পাড়াপ্রতিবেশি কাছাকাছির কন্যা। বয়সও একই সিরিয়ালে। সবাই বলাবলি করছিল, এরপরের সিরিয়াল আপনার। আমার কেবল চিনচিন করছিল ভেতরে মুখে কিছু বলতে পারিনি। 

কলকাতার একটা মুভি দেখেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। সেখানে একটা ডায়ালগ থাকে ‘আমার তো একটামাত্র নূর ছিল’ (যদিও তার প্রেক্ষিতটা ভিন্ন)… আমারও কেবল সে কথাটাই মনে হয়েছে সুইটি ভাবী-স্বপন ভাই একটি মাত্র নূরকে (সব মেয়েই বাবা-মায়ের কাছে নূর, ওর তো নামও নূর) ছেড়ে কিভাবে থাকবেন!? নিজেকেই নিজে বুঝালাম… সবাইকেই এরকম থাকতে হয়, হবে। মাইশা, আমাদের সবার আদরের (মাহবুবা নূর) আর রাহাতকে আল্লাহ চির সুখী করুক, এই দোয়া রইল। 

গতসপ্তাহে দ্বিমিত্রা আসবে না বলেও শেষ পর্যন্ত ওকে আনা হল মাইশার বিয়ের কারণে। শনিবার রাতে ওকে দিয়ে আসার সময় মজুমদার বলল, তোমার বেশি হোমওয়ার্ক থাকলে বা সমস্যা হবে মনে করলে আগামি সপ্তাহে আসার দরকার নাই। সাথে সাথে ওর উচ্চকণ্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর নওরোজের জন্মদিন। সেদিন আমি থাকতে পারব না, আগামি সপ্তাহে আমি আসবই। মেয়ের দৃঢ় উচ্চারণের কাছে বাপ চুপসে গেল। 

শুক্রবার রাত সাড়ে সাতটার দিকে মেয়ে এল বান্ধবীর সাথে। শনিবার আমার জন্য রাজ্যের কাজ জমে থাকে। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম কি রান্না করব বিরিয়ানি নাকি সিম তরকারি? সে সিম দিয়ে সাদাভাত খেতে চায়, তাই রান্না করলাম। ঘরের সপ্তাহান্তের কাজ শেষে, খাওয়া শেষে, ফুটবল বিশ্বকাপের দুই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা দেখে দোকানে গিয়ে কেক আনলাম। বেলুন আনলাম। নিজের জন্মদিনে এসব না হলেও চলে দ্বিমিত্রার কিন্তু ভাইয়ের জন্মদিনে ঘাটতি থাকা চলবে না। ও যা যা চাইবে তা দিতে হবে। 

মজুমদার তখনো কাজে। দুই শিফ্ট কাজ তার শনিবারে। আমরা বাসায় ফিরে কাপড় জামা পরে রেডি হলাম। মাতা-পুত্র-কন্যার ফটোসেশন হল। কাজ শেষ করে এসে গোসল সেরে সেও রেডি হল। কেক কাটা হল। কাজ, খাওয়া, ঘুম রোজনামচার সাথে জীবনটাকে এমনি করেই উপভোগ করতে হয় পাই পাই করে। আমি অন্তত তাই করি, নিরবচ্ছিন্ন অবসর নেই বলে গাল ফুলিয়ে দিন কাটানো আমার কর্ম নয়। 

মজুমদার সাহেবের খুঁতখুঁতটা রয়েই গেল ছেলেটার জন্মদিন, তুমি একটু বিরিয়ানি রান্না করলে না? তার উপর আজকে সারাদিন— ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে… শেষমেষ, রবিবারে বিরিয়ানি রান্না করলাম। ডিম, বেগুনভাজা আর সালাদ। খানাপিনা শেষে একটা ঘুম দিল মজুমদার। ঘুমের পর কন্যাদ্বয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে আরেকটা নতুন সকাল, নতুন দিন, নতুন সপ্তাহের প্রত্যাশা। 

১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতি হিসেবে একটি জনগোষ্ঠিকে হাজার বছর পিছিয়ে দেওয়ার দিন। এই দিনে জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের একদম শেষদিকে ঘটানো এক জঘন্য ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। তারা এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা প্রস্তুত করে। বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে ডেকে অনেককে একসাথে জড়ো করে। তারপর চোখ উপড়ে, আঙুল কেটে নানা রকম শারিরীক অত্যাচার করে হত্যা করে। 

বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই সব শহীদদের, আমরা তোমাদের ভুলব না। 

১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। এক সাগর রক্ত, এক নদী ত্যাগ তিতিক্ষা, লক্ষ প্রাণ আর অগণিত জায়া জননীর সম্ভ্রমের দামে কেনা আাদের স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাথা উচু করার দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু অমূল্যের বিনিময়ে এদিনে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের রক্তিম সূর্য।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তি পাগল মানুষের ওপর অক্সিত অত্যাচার-নির্যাতনের পর এই দিনে আত্মসমর্পণ করে মুক্তিকামী মানুষের কাছে। আর এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনার। নানা বৈষম্য, নির্যাতন, নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি, মুক্ত হয় সোনার বাংলা। 

এ বিজয় কেবল একটা ভূ-খন্ড বা মানচিত্রের বিজয় নয়। এ বিজয় ভেতর থেকে কোন বোধের, নিজস্বতার, সত্তার। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বেড়াতে গিয়েছিলাম ওয়াশিংটন ডিসিতে। এ নিয়ে আমাদের সেখানে তৃতীয়বার যাওয়া। আমরা হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। মোটা রাস্তার বিপরীত পাশে একজন সিডিপ্লেয়ারে জাতীয় সংগীত বাজিয়ে পেটের ধান্দা করছে। নানা রকমের ধান্দা পৃথিবীর সর্বত্রই আছে। আমরা যখন সেখানে তখন ভারতের জাতীয় সংগীত বাজছে। আমার বর বলল, আমাদেরটা যদি বাজাত? একটু পরেই বেজে উঠল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমি হেসে বললাম, লোকটা তোমার মনের ভাব ঠিক বুঝতে পেরেছে। আমাদের কন্যা হঠাৎ সচকিত হয়ে বলল,  আব্বু আব্বু ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইছে। মজুমদার বলল, তোমার ব্যাগে ভাংতি টাকা আছে? আবারও হেসে ফেললাম আমি, কারণ আমি জানতাম এর পরের প্রশ্নটা কী হবে। বললাম আছে, ছেলের হাত দিয়ে দশ ডলার দিলাম লোকটার বাক্সে। আর একটা ছবি তুলে নিলাম। জীবনের স্মৃতির ঝুঁড়িতে অভিজ্ঞতা জমাই। 

পরদিন গিয়েছিলাম বাল্টিমোর ইনার হারবারে। সেখানে আমাদের দ্বিতীয়বার যাওয়া। আগের বারেই আমি আবিস্কার করেছিলাম, হারবারের চওড়া চত্ত্বরে অনেক ভাষার সাথে বাংলা ভাষায় একটা বাক্য লেখা আছে ‘ঐতিহাসিক স্থানে পদব্রজে ভ্রমণ’। সময় স্বল্পতার কারণে দুই দলে বিভক্ত হয়ে বোটিং ও জাহাজ দেখার কারণে সেবার অন্যরা দেখেনি লেখাটি। এবার তাই সেই বাংলা লেখার গল্প করতে করতেই হাঁটতে থাকি। সবাইকে এ দৃশ্য দেখাব, এই উত্তেজনা কাজ করে ভেতরে। সবাই গোল হয়ে সেই বাক্যটির চারপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। আহা… আমার বর্ণমালা পৃথিবীর পথে পথে। আমার নিজস্ব একটা ভাষা আছে, একটা নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড আছে, একটা মানচিত্র, একটা জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা আছে… এ যে আমার গর্ব, এ যে অনাবিল শান্তি!

জীবন চলার পথে আমরা কত কত মানুষের সাথে পরিচিত হই। সবটা একরকমের দাগ কাটে না। কিছু কিছু মানুষ অন্যরকম করে জায়গা করে নেয় হৃদয়ের খুব কোমল ও সুক্ষ্ণ কোণে। কিছু মানুষের সঙ্গ আনন্দ দেয়, আপ্লুত করে। অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। জীবনের ভারসাম্য রাখার প্রেরণা দেয়। তেমনই একজন মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে সম্প্রতি। 

২০২১ সালের ২৬ মার্চ প্রথমবার দেখলাম। তবে গল্প শুনেছি তার কিছুদিন আগে থেকেই, কথাও হয়েছিল বোধহয় একবার ফোনে, ঐটুকুই। প্রথম দেখাতেই কাউকে ভাল লাগা আমার ক্ষেত্রে একটু কম প্রযোজ্য আমি তার উল্টো স্বভাবের। দু’তিনদিন বাসায় থাকার পর তার প্রতি অন্য রকম মায়া জন্মাল। সে মায়াকে ভালবাসা বলে, নাকি প্রেম বলে, নাকি স্নেহ, নাকি অন্যকোন নাম আছে তার জানি না। 

ক’মাস থাকল আমাদের বাসায়। কাজের দিনে সকাল-সন্ধ্যা আমাদের দেখা হয়, ছুটির দিনে সারাদিন! আমরা গল্পে মেতে উঠি। এতদিন শুনা কথা কম বলা মানুষটা আমার সামনে এলে মেলে দেয় তার কথার ঝুড়ি। গল্পে হারিয়ে যাই আমরা শৈশব-কৈশোর-দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি পেরিয়ে। আমরা যেন এক ফেলে আসা বিস্তৃত জীবনের গল্প বলে শেষ করতে চাই দু’জন দু’জনকে। কত গল্প যে করেছি সোফায় বসে, বারান্দায় চেয়ারে বসে, সিঁড়িতে বসে, রান্নাঘরে কাজ করতে করতে, সব্জি বাগানে পানি দিতে দিতে, সব্জি তুলতে তুলতে, খেতে খেতে…। এক জীবনের গল্প কী আর এক, দুই মাসে বলে শেষ করা যায়!? 

তারপর চলে গেল স্বস্থানে। দেখা হত মাঝেমাঝে, কথা হত। এরই মাঝে কত জায়গায় ঘুরলাম, বেড়াতে গেলাম ভার্জিনিয়া, বাল্টিমোর, স্টাচু অব লিবার্টিতে গেলাম, পার্কে, বিচে, রেস্টুরেন্টে… আহা কত স্মৃতি জমা হল আমাদের। ঘরে বসে ফোনে বিয়ে দিলাম ছেলের।ট্রান্সফার হয়ে চলে গেল আরো দূরে, জীবনের প্রয়োজনে… জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারি গবেষক হিসেবে।

আমাদের প্রত্যহিক টানাপোড়েন আর ঝড়ঝঞ্জার জীবনে অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর কিছু সময়ও চলে আসে। সে সব আমাদেরকে কষ্টের সময়গুলো অতিবাহিত করার রসদ যোগান দেয়। ডক্টর হাবিবের সাথে কাটানো সময়গুলো আমার জন্য তেমনই আনন্দের, প্রেরণার এবং সারাজীবন গভীর আবেগে স্মরণে রাখার। ১৭ ডিসেম্বর হাবিবের জন্মদিনে আমার প্রত্যাশা, ওর সাথে আরো অনেক অনেক স্মৃতি সঞ্চয় করতে চাই। 

১৯ ডিসেম্বর ২০২২ কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যকার ফাইনাল হল। নানা নাটকীয়তা ও উত্তেজনায় ভরা ছিল এই ফাইনাল। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে ৮০ ও ৮১ মিনিটের গোলে ফ্রান্সের সমতা। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ গোলশূন্য। দ্বিতীয়ার্ধের ১০৮ মিনিটের সময় গোল করে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গিয়ে আবারও ১১৮ মিনিটের গোলে সমতা। শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুটআউটে জয় পরাজয় নির্ধারণ। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়।  বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনা দলকে অভিনন্দন! অভিনন্দন সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল  মেসিকে!! 

এ খেলার অন্য নায়ক এমবাপ্পেকেও অভিনন্দন। খেলাটাকে এমন উত্তেজনাময়, উন্মাদনাময় করে তুলেছে সে একাই। বলা যায় এগার জনের বিপক্ষে একজনের লড়াই। দল পরাজিত হলেও অসাধারণ খেলেছে সে, পেয়েছে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট। ফাইনাল সত্যিকারের ফাইনাল হয়েছে। সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর একটা ম্যাচ উপভোগ করল বিশ্ব, করলাম আমিও। 

অনেকবছর পর এত উত্তেজনা নিয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখলাম। প্রথমার্ধ আর্জেন্টিনা খেলল, ফ্রান্স তেমন সুযোগ করতে পারল না। খেলাটাকে একপেশে মনে হতে লাগল। দ্বিতীয়ার্ধ ফ্রান্স খেলল, আর্জেন্টিনা তেমন সুযোগ পেল না। টেনশন হতে লাগল। অতিরিক্ত সময়ে দু’দলই সুযোগ পেয়েছে, মিসও করেছে অনেক। যারা বলেছে খেলা ছাড়াই আর্জেন্টিনাকে ট্রফি দিতে কিংবা যারা পেনাল্টি দিয়ে আর্জেন্টিনা জিতিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেছে তাদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে শেষ পর্যন্ত তো ফ্রান্স পেল বেশি পেনাল্টি। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না!? খেলা দেখতে বসতে হয় সাপোর্টার হয়ে, অন্ধ হয়ে নয়। 

নভেম্বর ২০ তারিখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যেমন একা দেখেছিলাম, আজ ফাইনালও তেমনই। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ থেকে আমার খেলা দেখা শুরু। ১৯৯৪ এ এসএসসি পরীক্ষার পর অফুরন্ত অবসর সময়ে ফুটবল খেলোয়াড় ছোট ভাইয়ের সাথে বিশ্বকাপের খেলা দেখেছি। তখন ভাতিজা/ ভাতিজিরা ছোট, খেলা বুঝে না। সেবার খেলা দেখার মত আনন্দ আর কোনদিন পাইনি, পাবও না এ জন্মে। 

১৯৯৮, ২০০২ ও ২০০৬ এর বিশ্বকাপ দেখেছিলাম বাসায় আমার ভাতিজা ভাতিজিদের নিয়ে মজা করে। সে দিনগুলো অনেক রকমের অভাব, অভিযোগ, অপ্রাপ্তির পরও অনাবিল আনন্দের ছিল। নানা করণে তারপর থেকে মনোযোগ কমতে শুরু করে। এখানকার একাকিত্বের জীবনও হয়তো তার একটা কারণ। তারপর… মাঝের কতগুলো সময় কেমন যেন আনমনা নাকি মনমরা ছিলাম, জানি না। ঘুরে দাঁড়িয়েছি, নিজের আনন্দের জন্যই করতে হয় অনেককিছু। খেলা দেখাও তার ব্যতিক্রম নয়। 

এই পুরো ২৮ দিন এবং তার আগে থেকে অনেকেই অনেক রকম ট্রল করেছে। ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, মজার ছলে নানা ধরনের কটাক্ষ বা দুঃখজনক বিষয়ও তুলে ধরেছে। আমার কখনোই সেই রুচি বা ইচ্ছা হয়নি। মজার ছলে দু’একবার নিজের পছন্দের কথা বলেছি, মজার ছড়া লিখেছি… এটুকুই। আসলে কোন কারণেই কারো পছন্দকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে না, নিজের পছন্দে কারো কটাক্ষও ভালো লাগে না। 

জীবদ্দশায় আর্জেন্টিনা, ইটালি, ব্রাজিল ও ফ্রান্স ক্রমান্বয়ে আমার প্রিয়’র তালিকায় থাকা সবগুলো দলের বিশ্বকাপ জয় দেখলাম। স্মৃতির পাতায় এটাও থাকবে লেখা হয়ে। খেলা দেখার সময় এবং মেসির হাতে ট্রফি দেখে যে কথাগুলো আমার মনে খেলে গেছে, সেগুলো আমার এক বন্ধুর কথার সাথে হুবহু মিলে যায়। সে লিখেছে- 

‘ডিয়েগো ম্যারাডোনা,

আর মাত্র দুটো বছর বেশি বেঁচে থাকলে আপনি আরেকটা কাপ হাতে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ পেতেন। আমি জানি, অন্য কোন এক পৃথিবীতে বসে আপনি আজ এই আনন্দ অনুভব করছেন। ১৯৮৬ থেকে ২০২২, এই যাত্রা… এই অপেক্ষা, আপনার চেয়ে অন্য কেউ বেশি করেছে বলে আমার মনে হয় না। আজ একটা অপেক্ষার শেষ হলো। হয়তো, আরেকটা প্রজন্মের জন্য শুরু হলো দীর্ঘ আরেকটা অপেক্ষা। তবুও, কিছু অপেক্ষা অনেক আনন্দের, অনেক মধুর। আমি আমার কল্পনায় আপনার সেই আনন্দভরা মুখটা দেখতে পাচ্ছি। এটাও আমার জন্য একটা সুখ।’ 

এক সলতের জীবন তো যেমন তেমন করে কাটিয়ে দেওয়াই যায়, আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের তা না করে উপায়ও নেই। আমি কিন্তু এ তত্ত্বের বিরোধিতা করি, যা আছে তা নিয়েই মেতে থাকি, মাতিয়ে রাখি। প্রথম দিকে ব্যাপারটায় দুনিয়ার আপত্তি ছিল মজুমদারের। এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। 

যেখানে যাই সেখানকার মানুষদের সাথে হৈ হল্লা করি, ছবি তুলি। কেউ কেউ আমার বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলে, কারো কারো কাছে ভালোও লাগে। দেখে আশ্বস্ত হই কিছু মানুষ অন্তত বুঝতে শিখেছে সময়টা বসে থাকে না, বয়ে যায়; কেবল স্মৃতিটাই থেকে যায়। একটা সময় স্মৃতি কেবলই মনের মণিকোঠায় রাখতে হত জমা করে এখন কিছু স্মৃতি ছবি করেও রাখা যায়। আমি সে কাজটাই করি, আমার ভালো লাগে। আমার অস্বস্তিকর সময় কমে যায়, মনকে প্রফুল্ল রাখে। যেখানে যাই যা কিছু দেখি ফ্রেমে বন্দি করি। ছবিটার দিকে তাকালে সেদিনের কথা, সে সময়ের কথা মনে পড়বে; এটাই প্রত্যাশা। 

২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কন্যা বাসায় এসেছে খ্রিষ্টমাসের ছুটিতে। শাওয়ার নিয়ে খেয়ে সোফায় বসেছে। ওকে বললাম, বাবা আমি তোর কোলে বসব নাকি তুই আমার কোলে? ও হেসে বলল তোমার যা ইচ্ছা। আমি অনেকটা সময় আমার দু’টো বাচ্চাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। মজুমদার এ সময় কাজে ছিল, মনে হল জীবনের ব্যস্ততায় এরকম করে জড়িয়ে ধরে রাখার ক্ষণটা কতই না হু হু করে কমে যাচ্ছে। 

এই দিনেই অফিসের খ্রিষ্টমাস পার্টি ছিল প্রতিবছরের মতই। কোভিডের কারণে মাঝে একবছর বন্ধ থাকার পর গতবছর থেকে আবারো হচ্ছে পার্টি। তবে আগের মত উন্মাদনা আর নেই, আগে পরিবার নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও এখন কেবলই অফিসের কর্মীরা। এছাড়া আবারো কোভিডের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, চীনে এক দিনেই তিন হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। ফলে সবার মধ্যেই একটা ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে। তারপরও আমরা অনেক মজা করলাম। 

২৪ তারিখ থেকে আমার খ্রিষ্টমাসের পুরো এক সপ্তাহের  ছুটি শুরু। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! কিন্তু আমার বরের একটা দিনও ছুটি নাই, বরং বছরের ঠান্ডাতম দিনেও ওর দুই শিফ্ট কাজ। জীবন এমনি করেই কাটছে, কাটবে আনন্দে-কষ্টে, কাজে-ব্যস্ততায়। এরই নাম জীবন। এর মধ্য থেকেই জীবনকে উপভোগ্য করে নিতে হয়, হবে। সবাইকে খ্রিষ্টমাস ও নববর্ষের শুভেচ্ছা।

কুলসুম আক্তার সুমী, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র

(২৬/১২/২০২২)