মনিরা সুলতানা পাপড়ি
আমেরিকান লেখক এবং হিউমারিস্ট এরমা বোম্বেক এর একটা লেখা পড়েছিলাম। তার কথাগুলো যদি আমার ভাষায় বলি – স্বর্গে গিয়ে যদি দেখার সুযোগ পেতাম বা দেখতে পেতাম, স্রষ্টা কিভাবে স্পেশাল মা বেছে নেন,কোন মায়ের কোলে স্পেশাল নীড বাচ্চা দেবেন।
তিনি একজন ফেরেশতাকে বলছেন- ” ওকে একটা মেয়ে দাও!” ” একে একটা যমজ বাচ্চা দাও।” “আর ওই যে ওকে একটা ছেলে দাও, ও প্রচুর স্ল্যাং বলে অভ্যস্ত, ওর জন্য ঠিক আছে ( বলে মজা নেন)!”
তারপর একজন বিশেষ ফেরেশতাকে বলেন- “এই মেয়েটা ভীষণ হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল, জীবনকে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে যেভাবে ইচ্ছে চলে। তাকে একটা স্পেশাল নিড বাচ্চা দাও!”
ফেরেশতা বলে- “এত হাসিখুশি একটা মেয়ে, জীবনকে এত উপভোগ করছে, একে স্পেশাল বাচ্চা দেবো?” স্রষ্টা বলেন- “যে জীবন বোঝে না, হাসতে জানে না তাকে একটা স্পেশাল বাচ্চা দেয়াটা অন্যায় হয়ে যাবে। ওর ধৈর্যও কম, কমই ভাল। বেশি হলে ও তো সব মেনে নেবে, নিজের ভেতরের বিষন্নতায় ডুবে যাবে। ও গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে, নতুন করে ভাববে, নিয়ম ভাঙবে এবং নিয়ম বানাবে। সে জীবন বোঝে, তাই একটা স্পেশাল বাচ্চা যখন ‘মা’ বলে ডাকবে, সেই ডাককে সে গ্রান্টেড হিসেবে নেবে না। তার বাচ্চা যখন একটা নড়বড়ে কদম দিতে পারবে, মানুষের পদধ্বনিকে সে গ্রান্টেড হিসেবে নেবে না। প্রতিমুহূর্তে সে অবাক হবে পৃথিবীর ছোট ছোট সাধারণের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ব্লেসিংস আর সৌন্দর্য দেখে।
সে খানিকটা স্বার্থপর। এটাই দরকার। নইলে সে নিজের জন্য বাঁচতে ভুলে যাবে। স্পেশাল নীড সন্তানকে টেক কেয়ার করতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে, সন্তানের জন্য হলেও তার নিজের জন্য ভালোভাবে বাঁচা দরকার।
এই মেয়েটা স্বাধীনচেতা। একজন মা হিসেবে সেটা খুব দরকার। অনেকে বুঝে না বুঝে একে জ্ঞান দেবে, ফতোয়া দেবে, বাচ্চার ব্যাপারে তাকেই দায়ী করবে,তাকে দাবিয়ে রাখতে চাইবে। সে সব ঝেড়ে ফেলে, সবাইকে ঝেড়ে ফেলে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে, সত্যিই কি দরকার তার সন্তানের জন্য। তার সন্তানের নিজস্ব জগৎ এবং স্বাভাবিক পৃথিবী দুটো আলাদা। এই দুটো পৃথিবীর সব ” অড” এর এগেইন্সটে সে নিজেকে এবং তার সন্তানকে বড় করে তুলবে। আমার একেই দরকার। স্ট্রং,ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আনএপলোজেটিক,আত্মকেন্দ্রিক এবং এবাভ অল সে হ্যাপী।”
ফেরেশতা জিজ্ঞেস করে- ” ওর জন্য কোন গার্ডিয়ান এঞ্জেল/ অভিভাবক দেবদূত দেবো না? এই কঠিন দুনিয়ায় তার লাগবে তো!”
স্রষ্টা বলেন- ” ওর ঘরে আয়না আছে। আয়নায় নিজেকে দেখলেই দেখতে পাবে, ওর গার্ডিয়ান এঞ্জেল ও নিজেই। আর আমি তো আছিই সবসময়, সারাক্ষণ ওর ছায়া হয়ে, কারণ আমার কাজ গুলো আমার হয়ে সে করে দিচ্ছে! “
এবার এরমার কথা ছেড়ে দিয়ে নিজের কথা বলি।
উন্নত দেশে, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিন্ড্রোম আক্রান্ত বাচ্চাদের চিকিৎসা বলতে তেমন কিছু নেই। আছে ম্যানেজমেন্ট, মেইন্টেনেন্স। বেটার জীবন ব্যবস্থা।
কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে যা নেই তা হলো প্রপার এডুকেশন, মায়ের এবং সমাজের।
একটা স্পেশাল নিড বাচ্চার মাকে সবার আগে, সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটা করতে হয়, সেটা হলো তার নিজের সাথে। এটা মেনে নেয়া যে , হ্যাঁ, আমার সাথেই এটা হয়েছে, আমার বাচ্চার সাথেই হয়েছে, আমার বাচ্চা আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মতো হবে না। অনেকের কয়েক বছর লেগে যায় এই কঠিন সত্যটাকে সত্যি বলে মেনে নিতে। ততোদিনে বাচ্চার অনেক দেরি হয়ে যায়, চিকিৎসায় এবং যত্নে। কারণ আপনি সমস্যা যে আছে সেটাই যদি ইগনোর করেন সমাধান কিভাবে করবেন?
তারপর শুরু হয় আসল যুদ্ধ। জানা। কি সমস্যা বাচ্চার, কোন ডাক্তার, কোন চিকিৎসা, কোন ওষুধ, কোন জীবনযাপন? কেউ নেই গাইড করার। এই দরজা থেকে ওই দরজায় ঠোকর খেয়ে খেয়ে শেখা। অনেকের তো বছর লেগে যায় শুধু এটা জানতে যে, কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
কেউ খুলে বলে না, আসল সমস্যাটা কি। কারণ আমাদের দেশের ডাক্তাররা মনে করেন- রোগী বা রোগীর গার্ডিয়ান কি বুঝবে এত জটিল কথা। ওনারা যে ভুল ভাবেন তাও না। আমরা সব করি, শুধু জানতেই চাই না স্পেশাল শিশুর ক্ষেত্রে কি করতে হবে। ডাক্তার যে বোঝায় সেটা বোঝার ক্ষমতাও তো অর্জন করতে হবে, তাই না?
ইন্টারনেটে কি নাই! তবে আমরা ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ, মাজার, ভন্ড হুজুর আর কুফরি কালাম নিয়ে বেশি আগ্রহী এবং বিশ্বাসী। ফ্যাক্ট এর কাছে যেতে চাই না। তারপর বাচ্চাটা আস্তে আস্তে এভাবে বড় হতে থাকে। চারপাশের বৈরী পরিবেশ। প্রতিবেশীদের কুঁচকানো চোখ, অভদ্র বডি ল্যাংগুয়েজ এবং অশ্লীল প্রশ্ন- ” আপনার বাচ্চা কি প্রতিবন্ধী, হাঁটতে পারেনা? কথা বলতে পারেনা?”
কি প্রশ্ন একটা বাবা-মাকে করা যায় বা যায় না এটা যদি আমাদের দেশে একাডেমিক কারিকুলামে থাকতো, খুব ভালো হতো। সমাজ আমাদের আয়না। এই প্রশ্ন গুলো শুনে শুনে সেই স্পেশাল বাচ্চাটাও কাউকে দেখে প্রথম প্রশ্ন করা শেখে – ” আপনি কি প্রতিবন্ধী?” ” আপনি কি কথা বলতে পারেন?”
স্রষ্টার কি রসবোধ! আসলেই তো৷ প্রতিবন্ধী আসলে কারা? এরাই কি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয়? এরাই কি বাক প্রতিবন্ধী নয়? যারা সব ক্ষমতা এবং শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও কাকে কি বলা উচিত বা উচিত নয় সেটা ফিক্স করতে পারে না?
এটাই তো আসল প্রতিবন্ধকতা। যে স্পেশাল নিড, তাকে শেখালে হয়তো শিখবে তার ক্ষমতা অনুযায়ী। কিন্তু এই সুস্থ এবং শিক্ষিত প্রতিবন্ধী মানুষ গুলো কি শিখবে? আমাদের দেশে একটা ভালো স্কুল নেই স্পেশাল নিড বাচ্চাদের জন্য। যে এক দুটা আছে সেগুলো এক্সপেন্সিভ এবং সাধারণের নাগালের বাইরে। তাহলে এই বাচ্চারা কি কিছু শিখবে না? স্বাভাবিক জীবন জানবে না? বাবা-মা শেখাবে বলবেন তো? তাহলে চাকরি করবে কে? একটা স্পেশাল নিড বাচ্চার পেছনে মাসে খরচ কতো কোন আইডিয়া করতে পারেন?
রাস্তায় একটা হুইলচেয়ার নিয়ে বের হবেন হুইলচেয়ার ফ্রেন্ডলি কোন রাস্তা নেই, একটা লিফট বা একটা সিঁড়ি নেই আলাদা করে হুইলচেয়ার ঢোকানোর জন্য।
একবার ভাবুন তো সব বাবা-মা কি প্রাইভেট কার এফোর্ট করতে পারে? তাহলে একটা হুইল চেয়ার নিয়ে এক বাবা-মা কিভাবে বাসে ওঠেন? যেখানে একজন সুস্থ মানুষই বাসে উঠতে হিমশিম খায়! সিএনজি করে কি হুইল চেয়ার ক্যারি করা যায়? একটা ওভারব্রীজ কিভাবে পার হয় একজন হুইলচেয়ারের মানুষ? কেউ ভেবেছে? কেউ ভাবে?
একজন কলিগ কে জানতাম যার বাচ্চা স্পেশাল এবং অলমোস্ট ভেজিটেটিভ পর্যায়ে। কোন নড়াচড়া করতে পারে না। তার পৃথিবীতে কোন আলো নেই, শব্দ নেই, প্রাণ নেই, শুধু আছে ভোগান্তি, অশেষ ভোগান্তি। সেই কলিগ বলতেন- “পাপড়ি,আমি অফিসে আসলে ভালো থাকি।”
জাজ আপনারা করতেই পারেন, “এ কেমন কথা?”
কিন্তু জানেন, দিনের পর দিন একটা অসুস্থ বাচ্চাকে চোখের সামনে একই অবস্থায় বরং দিন দিন অবস্থা খারাপ হতে দেখা একজন মায়ের জন্য কত কষ্টের? কত দম বন্ধ লাগে তার? তার মেন্টাল হেলথ নিয়ে কেউ ভাবে? তাকে দেখতাম সবসময় বিরক্ত, রেগে থাকতো। আর যখন কথা বলতো, তখন হড়বড় করে বলতো। কারণ তার এত কিছু বলার আছে, কিন্তু শোনার কেউ নেই। আমি শুনতাম। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগতো তবু শুনতাম।
আজকে আমার বাচ্চা স্পেশাল নিড। আজকে আমি সেই কষ্টগুলোকে শুধু কান দিয়ে না,মন দিয়ে বুঝি, শরীর দিয়ে বুঝি,আমার অগাধ পেইশেন্স দিয়ে বুঝি। আমি বুঝি তার কেমন লাগতো, যখন সকালে এই বাড়ন্ত শরীরের বাচ্চাটাকে তার প্রস্রাবে প্রায়ই ভিজে থাকা কাপড় চোপড় চেঞ্জ করে, সারা বছর ডায়াপার পরাতে হয়, সো ডায়াপার চেঞ্জ করে শরীর মুছিয়ে তাকে কোলে করে হুইলচেয়ারে বসাতে কেমন লাগে!
তার দাঁত ব্রাশ করানো তৃতীয় যুদ্ধের শামিল, থুতু দিয়ে,পানি ফেলে আবার শরীর ভেজাবে আবার ড্রেস পাল্টাও, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে খাওয়াও। যেহেতু তাদের মুখের মাসল ঠিকমতো কাজ করে না, সো খাবার চিবোতে পারে না, প্রতি দুই লোকমায় একবার বমি করে ফেলে। বমি পরিস্কার করো, কিন্তু নিজে বমি করা যাবে না এটা দেখে, প্র্যাক্টিস কর। নিজে কখন খাবার ফুরসৎ পাবে সেটা পরে আসবে।
গোসল করানোর সময় সেইম। মায়ের ব্যাকবোনের কি অবস্থা, কিছু আসে যায় না। ক্যারি তো করতেই হবে। পুরো বাথরুম পানিতে ছিটবে, বাথটাব থাকলে তাকে একজন ধরে থাকা লাগে নইলে সে পানিতে ডুবে যায়। ভাবুন তো একজন বাথটাবে বসে আছে আর তার শরীরের পুরো ব্যালেন্স আপনাকে রাখতে হচ্ছে অন্তত মিনিমাম আধাঘণ্টা ! আপনার শরীর আপনাকে বলতে থাকবে – ” আর পারছি না, আমাকে ক্ষমা করো।”
সবচেয়ে কঠিন পার্ট প্রতিদিনের। অন্তত আমার জন্য। কারণ আমি স্মেল সেন্সিটিভ। যেকোন সূক্ষ গন্ধ আমি তীব্রভাবে পাই এবং আমার সাফোকেশন হয়। বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে তার পায়খানা প্রস্রাবের গন্ধ তীব্র হয় এবং ম্যানেজমেন্ট কঠিন হয়ে পড়ে। যেহেতু সে ডায়াপার পরে, শুয়ে শুয়েই তার সব প্রাকৃতিক কাজ হয়। পায়খানা করার পর প্রতিবার তার শরীর মাখামাখি হয়ে যায় যেটা বাথটাবে নেয়া ছাড়া ক্লিন করা পসিবল না।
এবার কষ্ট দেই আপনাদের একটু। কল্পনা করুন তো, একটা সাড়ে চার ফুট লম্বা ত্রিশ কেজি ওজনের বাচ্চাকে কোমর থেকে উরু পর্যন্ত পায়খানায় মাখামাখি অবস্থায় কোলে করে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ঠান্ডা বাথটাবটায় শোয়ানো এবং তাকে ক্লিন করা। তার কোন বোধ নেই,সে খিলখিল করে হাসছে অথবা হাত-পা ছুঁড়ছে। আপনার সাফোকেশন হচ্ছে ………
মাঝেমধ্যে পৃথিবী থেমে যায়, শব্দহীন হয়ে যায়। আগে অনেক দাওয়াতে যেতাম,অন্যদের দাওয়াত দিতাম। আজকাল ইচ্ছে করে না। কারণ নিজের বাসায় একটা স্পেশাল বাচ্চাকে ডিল করা আর ঘর ভর্তি ভিন্ন মানসিকতার ভিন্ন বয়সের মানুষের মাঝখানে এই বিশেষ চাহিদার বাচ্চাটাকে ডিল করা সেইম না। ইনসিকিউরড এবং স্ট্রেসফুল।
ইনসিকিউরড কারণ তার খারাপ লাগা সে এক্সপ্রেস করতে পারে না, ব্যথা পেলে বলতে পারবে না। কিংবা অন্য বাচ্চাদের ব্যথা দিয়ে দেবে। সবার তো সেটা বোঝার কথা না।
স্ট্রেসফুল, কারণ- স্পেশাল নিড বাচ্চাদের রিপিটেটিভ বিহেভিয়ার আছে। টিভি ছাড়লে একই গান বারবার বাজাতে হয় চব্বিশঘণ্টা, এক ই জিনিস বারবার প্লে করতে হয়। অন্যান্য বাচ্চাদের পছন্দ অপছন্দের সাথে তার তাল মেলে না। এবং সেটাও অন্যদের বোঝার কথা না। বুঝবে না।
সবচেয়ে হার্ড পার্ট। টিভি দেখায় মনোযোগ এলে সেখান থেকে তাকে সরানো যাবে না। তার বয়স দশ, কিন্তু তার মানসিক বয়স দু বছরের বাচ্চার মতো। দশ বছরের বাচ্চার গলায় যে শক্তি এবং আওয়াজ আছে সেটা দিয়ে দুই বছরের বাচ্চার মত করে চিৎকার করে যে কান্না সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ খুব কম মানুষকে দিয়েছেন, স্পেশাল বাবা- মা সেই কম মানুষদের মধ্যে পড়ে।
ভায়োলেন্স, স্পেশাল নিড বাচ্চার হরমোনাল চেঞ্জ এর সাথে সাথে আরেকটা এডেড পার্ট। আমার বাচ্চার ক্ষেত্রে অন্তত। রেগে গেলে সে খামচি দেয়,তার অপারগ শরীরের এবং ক্ষুব্ধ মনের সমস্ত রাগ সে তার দাঁতে এনে ফেলে কামড়ায়। শরীর থেঁতলে যায়, রক্তাক্ত হয়ে যায় আর সাথে সেই তীক্ষ্ণ, তীব্রতার স্বরে চিৎকার। মানুষের বিরক্ত চোখ ( স্বাভাবিক), অস্বস্তিকর নীরবতা।
মনে হয় আমার বা আমাদের কোন অধিকার নেই একটা পরিবেশের পরিবেশ নষ্ট করবার। কারণ সবাই স্ট্রেসড হয়ে যায়। আপনি আপনার স্পেশাল নিড বাচ্চার জন্য যতোই ওপেন এবং হেল্পফুল এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোন না কেন, আপনি নিশ্চয়ই একটা কোন সুন্দর এম্বিয়েন্স এ স্ট্রেস তৈরি করার কারণ হতে চাইবেন না।
আরো একটা বিষয় হয়তো স্বাভাবিক বাচ্চার বাবা-মায়ের জানবার কথা না। একটা স্পেশাল নিড বাচ্চা যার কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট আছে, হিয়ারিং ইম্পেয়ারমেন্ট আছে। সে আপনার আমার মতো তার প্রয়োজনীয় শব্দে ফোকাস করতে পারেনা, ফিল্টার করতে পারে না। প্রতিটা শব্দ, ছোট খাটো খুটখাট আওয়াজ, গাড়ীর হর্ণ, তীক্ষ্ণ কাশি, অনেক আওয়াজ সব একসাথে তার কানে যায়, সে একটা শব্দের যন্ত্রণাময় সাগরে পড়ে যায়, যেখানে সে সাঁতরাতে জানে না। সে তো অস্বস্তিবোধ করবেই, এবং অন্যদের অস্বস্তি দেবেই।
আপনি না বুঝে কিন্তু আদর করে তাকে সবার সাথে খেলার জন্য জোর করতেই পারেন, কারণ আপনি কাইন্ড। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে সে স্পেশাল নিড। আপনার চেয়ে তার প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, ঠিক, বেঠিক তার বাবা- মা বেটার বোঝে, যেহেতু তাকে সামলাতে হয়। তাই স্পেশাল নিড বাবা-মায়ের সাথে কি কথা বলা উচিত, কি উচিত নয় এটা জানাটাও দরকার।
আজকাল মাঝেমধ্যে কয়েক ঘন্টার জন্য বন্ধুস্থানীয় বেবি সিটারের হেল্প নিয়ে একটু আধটু ওকে ছাড়াই বের হই,কিন্তু মন পড়ে থাকে বাসায়,ওর কাছে।
এতোকিছুর মধ্যে আমার ভুলে গেলে চলে না আমার আরেকটা সুস্থ, স্বাভাবিক বাচ্চা আছে যার স্বাভাবিক জীবনের অধিকার আছে,তারও এটেনশন দরকার। তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ আর স্পেশাল নিড বাচ্চাকে এক্সট্রা কেয়ার নেয়ায় তার মনে প্রশ্ন জাগে,তাকে কি আমরা কম ভালোবাসি? সে প্রশ্ন করে তার ভাই কেন তার সাথে খেলে না? সে প্রশ্ন করে তার ভাই কবে হাঁটতে পারবে?
একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,মগ্ন তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? সে বলেছিলো,” মা আমি বড় হয়ে মেঘের মতো হুইলচেয়ারে বসতে চাই,তাহলে তোমরা আমাকেও ওর মতো সারাক্ষণ টেইক কেয়ার করবে, আমি যা চাইবো তাই দেবে!”
আমার পৃথিবী আরেকবার শব্দহীন হয়ে গিয়েছিল। জানিনি, বুঝিনি ঠিক কি বলে পাঁচ বছরের বাচ্চাকে এই বাস্তবতা বোঝাতে পারবো, যে তার ভাইয়ের এক্সট্রা কেয়ার প্রয়োজন। তারপর থেকে খুব কনশাস থাকি যেন কখনো সে লেফট এ ওয়ে বা লেস লাভড ফিল না করে এবং সেটা খুব সহজ কিছু না।
এই তো একটা স্পেশাল মায়ের জীবন।
যে মানুষটা রাতে কয়েকবার উঠে চেক করে বাচ্চা কি কাত হতে চায়, না চিত হতে চায়, ডায়াপার লিক করে কি প্রস্রাবে ভিজে, শীতে কাঁপছে বাচ্চা? ঘুমাতে পারছে না? তার কয় ঘন্টা ঘুম হয়? সে মানুষ টা যদি সকালে উঠে সুস্থ স্বাভাবিক ব্যবহার করে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, কম্পিটিটিভ ক্যারিয়ারে বিল্ট করে, নিজেকে ফিট রাখে, এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটি করে, নিজের ভালোলাগার কাজ করে যাবার ক্ষমতা রাখে, তার কি আসলে অভিভাবক এঞ্জেল, গার্ডিয়ান এঞ্জেলের দরকার আছে? তার জন্য একটা আয়নাই যথেষ্ট। সে নিজেই তার এঞ্জেল।
আর আপনাকে বলি। যদি আপনি সুস্থ আছেন, আপনার এরকম স্পেশাল নিড একটা মানুষকে দেখাশোনা করতে হয় না, তবু আপনি যদি আপনার জীবনকে যথেষ্ট সুন্দর মনে না করেন, সহজ মনে না করেন, নিজের স্বপ্ন গুলো কে পারস্যু করতে না পারেন, তাহলে জিজ্ঞেস করতে চাই-
What’s your excuse????
মনিরা সুলতানা পাপড়ি, সুইডেন থেকে