লাবনী হোসেইন
আগের পর্বেই বলেছি কানাডা শহরের প্রথম দুই-একমাস ভাল কাটলেও তার কিছুদিন পর থেকেই আমাকে পেয়ে বসে ভয়াবহ এক নি:সঙ্গতা। চারপাশের কিছুই যেন আমার নয়। কোন গাছপালা, পাখি কোনকিছুতেই আমার দেশ, পরিচিত কিছু খুঁজে পাইনা। মন পড়ে থাকে আমার দেশ, আমার বাড়ির ঘর, জানালা, রাস্তা সবকিছুতে। এরই মধ্যে এখানে শুরুতে কিছু কিছু জিনিজ বুঝতেও সমস্যা হতো। আজ দুটো ঘটনা তুলে ধরছি। একটা হাসির আর একটা আমার একাকীত্বের। কারণ আমার দিন-রাত্রি তো তখন এসব নিয়েই।
এক
আফ্রিকান কিশোর এবং আমার না জানা ফ্যাশন
মাথাভর্তি কোঁকড়ানো ঘন চুল। মাথার সামনে পাম্প করে তার মধ্যে চিরুনি লাগিয়ে ঘুরছে। আমি দেখামাত্র তাকে বললাম, এই ছেলে এভাবে মাথায় চিরুনি নিয়ে ঘুরছো কেন ? ভুলে গেছো কি? মাথায় রেখে দিয়েছো… সে লজ্জায় কালোর মধ্যে লাল হয়ে দিশেহারা হয়ে মাথা থেকে চিরুনি খুলে তার লকারে রেখে দিলো। পরে আমি বুঝলাম এবং জানলাম, এটা তাদের ফ্যাশন। ঘটনাটা তার জন্য বিব্রতকর হলেও নিজের অজ্ঞতা ও বোকামির জন্য সেদিন লজ্জা না পেয়ে বরং মজা লাগছিল। কারণ এটা যে একটা ফ্যাশন হতে পারে তা আমার ধারণারও বাইরে ছিল। এরপর যতোবার মনে হয় অজান্তেই হা হা হা করে হেসে উঠি।
দুই
নি:সঙ্গতার সঙ্গী যখন কাক
জেনে অনেকেই অবাক হতে পারেন, আমি যখন কানাডায় আসি তখন শুরুতে পাখিদের মধ্যে কাক কে ভীষণভাবে মিস করছিলাম। আমার চারপাশে কোথাও কাকের ডাক নেই। হঠাৎ একদিন কাকের কা-কা ডাক শুনে তার অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। আমার মন বারবার বলতে লাগলো ‘হৈমন্তী’ গল্পের সেই লাইনটির মতো, “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম”। আমার মনে হতে লাগলো আমি দেশে আছি। এভাবে ছোট ছোট আরো কিছু কিছু অভাব বোধ করতে লাগলাম। অভাবগুলো একসময় বিন্দু থেকে একপ্রকার সিন্ধুতে জমে জমে ভারী হলো। যার ভার বহন করা আমার পক্ষে একপ্রকার দুঃসাধ্য ছিল। এই দুঃসাধ্যকে উড়িয়ে দিলাম কাকের ডানায় করে আমার আকাশে। এখন কথা হচ্ছে কাক দেখলে বা কাকের ডাক শুনলে দুটো বিপরীতমুখী ভাবনা চলে আসে আমার মনে। একটা ভয়ের আরেকটা আনন্দের। ভয়টা হচ্ছে, জানালার কাছে বা তার বরাবর কোথাও থেকে কাকের কা-কা ডাক শুনলে মনে হয় কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। একদিন এভাবে কাক ডেকে যাবার পর আমার বোনের মৃত্যুর দুঃসংবাদটি এসেছিল। এরপর থেকে জানালার কাছে বা তার সামনে কোথাও কাকের ডাক শুনলেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই। আর আনন্দ হয় যখন অনেকদিন পর কাক কা-কা করে ওঠে। মনে হয়, আহা এইতো আমার পাশে কেউ আছে, সে আমার খুব আপন কেউ। আমার দেশের, আমার মাটির প্রাণ।
লাবনী হোসেইন, মন্ট্রিয়াল, কানাডা থেকে